আরাকানে রোহিঙ্গা হত্যা: এবারই ব্যতিক্রম মিয়ানমার

প্রকাশিত: ২৬ নভেম্বর ২০১৬, ০৮:৫২ পিএম

মিয়ানমানের রাখাইন রাজ্য। বিশ্ববাসীর কাছে এ অঞ্চলটি কয়েক দশক ধরেই আলোচিত। তবে সেই পরিচিতি কিন্তু ভালো কোনো দৃষ্টান্তের জন্য নয়, গণহত্যা আর উদ্বাস্তুর জন্য। সেই ধারাবাহিকতায় নতুন করে আবারো আলোচনায় এলো বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারের এ অঞ্চলটি। যেখানে দেশটির সীমান্ত চৌকিতে সম্প্রতি অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হয় মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনীর ৯ সদস্য। এর পরই সন্ত্রাসী ধরার নামে মুসলিম অধ্যষিত আরাকানে শুরু হয় অভিযান। হাজারো নিরিহ-নিরস্ত্র মানুষের বাড়িঘরে দেয়া হয় আগুন, নির্মমভাবে হত্যা করা হয় শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষকে। যা এখনো অব্যাহত। সীমান্ত চৌকিতে হামলার জন্য স্থানীয় সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনকে অভিযুক্ত করছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী।

জাতিসংঘের হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী হলো এই রোহিঙ্গারা। যারা আজকের মতো একাধিকবার বিগত কয়েক দশকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা অন্যান্য বারের মতো এবারও একটি বিবৃতি দিয়েছে। মিয়ানমারকে বলেছে, নিয়মতান্ত্রিকভাবেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। কিন্তু কই? কোনো উন্নতিই লক্ষ্য করা যায়নি।

এদিকে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া মানুষগুলো সেনাবাহিনী আর স্থানীয়দের নৃশংস হামলা থেকে জীবন বাঁচাতে ছুটছে সীমান্তে। একটু নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টায়ও ব্যর্থ হচ্ছে তারা। তবে কেউ কেউ রাতের আঁধারে বাংলাদেশ-মিয়ানমারকে পৃথককারী নাফ নদী পাড় হয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত এলাকা দিয়ে ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে। তবে, এই অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তৎপর রয়েছে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি।

বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যটিতে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বসবাস। যেটি আরাকান রাজ্য হিসেবেও পরিচিত। শতবছর ধরে এ জনগোষ্ঠী ওই অঞ্চলটিতে বসবাস করলেও তাদের আজও নাগরিকের স্বীকৃতি দেয়নি মিয়ানমার। এমনকি দুটির বেশি সন্তান জন্ম দেয়া নিষিদ্ধ থেকে শুরু করে অনেক বিষয়েই তাদের নেই স্বাধীনতা।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মুসলিম হওয়ায় স্বভাবতই তাদের বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ কাজ করে। রোহিঙ্গারাও রাখাইন রাজ্যে কোনো হামলা বা সঙ্কটের সম্মুখীন হলে ভীড়তে চায় বাংলাদেশের ভূখন্ডে।আর এভাবেই একে একে এখন বাংলাদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৩ লাখের বেশি। যাদের বসবাস কক্সবাজারসহ আশপাশের সীমান্তে। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের জন্য অনেকটা বোঝাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

একদিকে মানবতা, অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ। এই দুটো বিষয় সামনে রেখে খুব ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বিভিন্ন সংগঠন মিয়ানমারের এ গণহত্যা বন্ধের দাবিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে করছে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। যা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও হচ্ছে। কিন্তু কোনোই ব্রুক্ষেপ নেই মিয়ানমারের।

এ সঙ্কট শুরুর পর থেকেই নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্মীয় দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকার অনুমতি দিলেই এ সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান হবে না। এ সঙ্কট সমাধান করতে হবে মিয়ানমারকেই। আর এজন্য বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যন্য দেশ ও সংস্থার সঙ্গে একাত্ম হয়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে বাধ্য করতে হবে মিয়ানমারকে। তবেই হবে এর সমাধান।

অবস্থা যখন এমন, তখন বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছিল বাংলাদেশ সরকার কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সেই প্রশ্নের জবাই ২৩ নভেম্বর দিল সরকার।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডাকলো বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মি ইউ থানকে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হলো। পরে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক জানালেন, বসে নেই বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও নির্যাতন বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আহ্বান করা হয়েছে দ্রুতই এ গণহত্যা বন্ধের।

সচিব জানান, ইতোমধ্যে এই রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানে পাঁচ বার তিনি গিয়েছেন মিয়ানমারে। এছাড়া সেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও যোগাযোগ করেছেন দেশটির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। তবে, পররাষ্ট্র সচিব একটি কথা জোর দিয়ে বলেছেন যে, এ সমস্যা মিয়ানমারের, সমাধানও করতে হবে মিয়ানমারকেই। বাংলাশে একটি দায়িত্বশীল দেশ হিসেবে যা করার তাই করছে।

অন্যদিকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী বৃহস্পতিবার জানান, কিছু রোহিঙ্গা মানবিক কারণে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অনেকেই প্রবেশের চেষ্টা করছে। তাদের খাবারসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে আবার মিয়ানমারেই ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে যৌথভাবে কাজ করছে। এছাড়া আর কোনো অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাকে নতুন করে নিবন্ধনের চিন্তা আপাদত নেই সরকারের এমনটাই জানান মন্ত্রী।

উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস মিয়ানমারে। যেখানে বাস করে ৮ লাখ রোহিঙ্গা। এছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও রয়েছে তাদের বসবাস। এর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এখানে বাস করে ৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। তবে এর পরিমাণ ৫ লাখের কাছাকাছি বলেও তথ্য দিচ্ছে উইকিপিডিয়া। এছাড়া পাকিস্তানে ২ লাখ, থাইল্যান্ডে বাস করে ১ লাখ রোহিঙ্গা। মালয়েশিয়ায় বাস করে ২৪ হাজার জন। ভারত এবং সৌদি আরবেও তাদের বসতি রয়েছে। তবে কোনো দেশেই নেই তাদের স্বীকৃতি।

অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে মুসলমানদের বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভূত এই জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের কাছে মায়্যু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের চেয়ে মধ্য আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাও শহরতলীতেই বসবাস করতে পছন্দ করতো। এই অঞ্চলের বসবাসরত মুসলিম জনপদই পরবর্তীতে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে।

মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম ও বৌদ্ধ রাখাইনদের মধ্যে ২০১২ সালে সবচেয়ে বড় দাঙ্গা বাঁধে। এতে প্রাণ গেছে বহু মানুষে। জীবন বাঁচাতে তখনও বাংলাদেশে পালিয়ে আসে অনেক রোহিঙ্গা।

তবে এবারই একটি বিষয় ব্যতিক্রম। অন্যান্য বার মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ছাড়ার বিষয়ে কড়াকড়ি না করলেও এবার তারা রায়েছে সতর্কতায়। বিবিসি বাংলার একটি ভিডিও প্রতিবেদনের দেখা যায়, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা কড়া পাহারা দিচ্ছেন। যাতে কেউ পালাতে না পারে। অন্যদিকে চলছে গণহত্যা। সর্বশেষ কোনো হিসাব প্রকাশ না করলেও সপ্তাহখানেক আগে দেশটির সরকার বলেছে ৬৯ জন রোহিঙ্গা অভিযানে নিহত হয়েছে। আর আটক করা হয়েছে ৩ শতাধিক। তবে প্রকৃত সংখ্যা কয়েখগুণ বেশি বলেই আভাস দিচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।

মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সেনাদেও সীমান্তে কড়াকড়ির বিষয়টিও ফুটে উঠেছে ২৩ নভেম্বর। যেখানে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত একটি বৈঠক করে বাংলাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) ও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। কক্সবাজারে বিজিবির আমন্ত্রণে মিয়ানমার থেকে বিজিপির প্রতিনিধি দল আসে বিজিবির রেস্ট হাউজে। সেখানে আলোচনা হয় কীভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো যায়। এতে দু’পক্ষই রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে একমত হয়েছে বলে জানান বিজিবির স্থানীয় কমান্ডার। মিয়ানমারের বিজিপি জানায় তারা তাদের সীমান্ত দিয়ে কেউ যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ না করতে পারে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করবে।

কিন্তু বিগত সহিংসতা আর দাঙ্গার সময় তাদের এ নীতি ছিলনা। তারা শতবছর ধরেই চেয়েছে রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়ে যায়। সে লক্ষ্যেই বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠরা বিভিন্ন সময় গণহত্যা চালিয়েছে মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর। এবারও তাই হচ্ছে। শুধু পরিবর্তন এসেছে, কেউ যাতে পালাতে না পারে এ নীতিতে। এতে বাড়ছে প্রাণহাণির সংখ্যা।

লেখক: সাংবাদিক

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: