‘মাইয়া বাচ্চা দেখ‌লেই কইলজাডা খা খা ক‌রে’

প্রকাশিত: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ০২:৪০ এএম

প্র‌তি‌দিন যে বাদামওয়ালার কাছ থে‌কে বাদাম কি‌নি, কথায় কথায় জান‌তে পারলাম তার তিন‌টি সন্তানই ছে‌লে। কি‌শোরগ‌ঞ্জে গ্রা‌মের বা‌ড়ি‌তে স্ত্রী আর ছে‌লেরা থা‌কেন। লোক‌টি সপ্তাহা‌ন্তে একবার গি‌য়ে দেখা ক‌রে আসেন। তিন‌ ছে‌লেই স্কু‌লে যায়। এক পর্যা‌য়ে দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে লোক‌টি বল‌লেন, ‘একটা মাইয়ানাই দেইখা খুব আফসুস গো মা, মাইয়া বাচ্চা দেখ‌লেই কইলজাডা কেমন খা খা ক‌রে।’

আমা‌দের বাসায় এক খালা কাজ কর‌তেন। তার ছিল তিন‌ মে‌য়ে। কোথাকার এক গণক যেন তার হাত দে‌খে বল‌লেন, ‘তোর এরপরের বাচ্চা‌টি হ‌বেছে‌লে। অশি‌ক্ষিত মানুষ, ছে‌লে বাচ্চা হ‌বে সেই আশায় আরো এক‌টি সন্ত‌ান হ‌লো, মেয়ে সন্তান‌। এদিকে খালা কিছু টাকা জমি‌য়ে‌ছিলেন জায়গা কি‌নে ঘরতুল‌বেন ব‌লে। শেষ বয়‌সে সন্তান হ‌তে গি‌য়ে অসুস্থতার কার‌ণে তাও শেষ হ‌য়ে গেল। তিন‌ মে‌য়ে তো আছেই, খালা চাই‌লেন শে‌ষের মে‌য়ে‌টি কাউকে দি‌য়েদে‌বেন। মে‌য়ে‌টিও ভা‌লো থাক‌বে আর তি‌নিও দেনামুক্ত হ‌বেন। খালার স্বামী স্টিমারঘা‌টে কু‌লির কাজ ক‌রেন। কো‌নো‌দিন খাবার জো‌টে তো কোনো‌দিনজো‌টে না এমন অবস্থা। হাসপাতা‌লে মে‌য়ে‌শিশু‌টি‌কে নি‌তে তার নতুন অভিভাব‌কেরা এলেন। আর তখনই খালার স্বামী অর্থাৎ শিশু‌টির বাবা মে‌য়ে‌কে বু‌কেচে‌পে ধ‌রে দি‌লেন এক দৌঁড়। তি‌নি কিছু‌তেই তার মে‌য়ে‌টি‌কে দে‌বেন না। বললেন, ‘য‌দি আমি মে‌য়ের মুখটা না দেখতাম, তবু একটা কথা ছিল।মে‌য়ে‌কে দি‌য়ে দি‌লে এই মায়া আমি কেম‌নে কাটা‌বো!’ অগত্যা আগ্রহী অভিভাব‌কেরা খা‌লি হা‌তেই ফি‌রে গেলেন।

মে‌য়ে‌শিশু যে আল্লাহর দেওয়া বি‌শেষ রহমাত এটা বোঝার জন্য ধনী আর শি‌ক্ষিত হ‌তে হয় না, প্র‌য়োজন মান‌বিকতার।

আমা‌কে প্রায় প্র‌তি‌দিনই কিছু মে‌য়ে নক ক‌রে তা‌দের কথা ব‌লেন। যা‌দের বে‌শিরভা‌গের মা-বাবা বেশ ধনী। কিন্তু, ওদের অভিযোগ, মা-বাবা জোর ক‌রে বি‌য়ে দি‌তে চায়। পড়া‌লেখা করা‌তে চায় না। প‌রিবা‌রের ছে‌লে সন্তান‌টি‌কে বে‌শি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

এক মে‌য়ে নক ক‌রে বল‌ল, ‘জা‌নো আপু, টেস্ট পরীক্ষার ফি দেওয়ার সময় আব্বু অনেক কথা শু‌নিয়ে‌ছেন; কিন্তু প্রায়ই আমা‌কে সে‌জেগু‌জে পাত্রপ‌ক্ষের সাম‌নে বস‌তে হয়, তা‌দের আদর আপ্যায়‌নে আব্বু অনেক টাকাও খরচ ক‌রেন, তখন কো‌নো সমস্যা হয় না। অথচ আমার পড়া‌লেখার খর‌চের কথা উঠ‌লেই নানাভাবে কথা শোনান!’

প্রচুর মে‌য়ে ব‌লে যে তারা শুধু মা-বাবার মু‌খের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বি‌য়েটা ক‌রে‌ছে। স্বামী অত্যাচারী, শ্বশুরবা‌ড়ির লো‌কেরা অত্যাচারী, মান‌সিক-শ‌ারী‌রিক নানাভা‌বে ক‌ষ্ট দেয়।

এদেশে ‌মে‌য়েদের জীবনটাই যায় এভা‌বে। মা-বাবার মু‌খের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বি‌য়ে আর তারপর মা‌নি‌য়ে নেওয়া। মা‌নি‌য়ে নি‌তে নি‌তে জীবনটাই শেষ হ‌য়ে যায়।

মানুষ কী বল‌বে, সমাজ কী বল‌বে ভাব‌তে ভাব‌তেই নি‌জের কথা আর ভাবা হয় না। কেন রে মা-বাবা, এত কষ্ট ক‌রে লালন-পালন ক‌রে মে‌য়ের মতাম‌তের তোয়াক্কা না ক‌রে একজ‌নের ঘা‌ড়ে তু‌লে দি‌লেই কি দায়িত্ব শেষ? মে‌য়ে‌টির বা‌কি জীবনটা কীভা‌বে কাট‌বে একটু কি ভে‌বেও দে‌খেন না!

আপনারা মা-বাবা, বি‌য়ে দেওয়াটা আপনা‌দের কর্তব্য। বি‌য়ে দিন। ত‌বে তার আগে এটুকু অন্তত নি‌শ্চিত করুন, মে‌য়ে‌টি তার ক্যা‌রিয়ার গড়ার সু‌যোগটুকু পা‌বে। ভ‌বিষ্যৎ কার জন্য কীভা‌বে অপেক্ষা কর‌ছে কে জা‌নে? কখ‌নো একা হ‌য়ে গে‌লে মে‌য়ে‌টি যেন কা‌রো বোঝা না হ‌য়েই বেঁ‌চে থাক‌তে পা‌রে!

লেখক : হাবীবাহ্ নাসরীন
সাংবাদিক ও কবি

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: