শ্রমে-ঘামে আজও অটুট

প্রকাশিত: ০১ জানুয়ারি ২০১৭, ০৪:৩৫ এএম

নিউজ ডেস্ক: সেই তাঁতে চলছে নানা রঙের সুতার কারুকাজ। মানানসই গামছা বুনে চলেছেন তাসলিমা বেগম (৩৫)। আর বারান্দার অন্য পাশে চরকায় সুতা কাটছেন আব্দুল মান্নান (৫০)। এই দম্পতি শ্রমে-ঘামে-মমতায় গামছা বুনে ধরে রেখেছেন বাপ-দাদার পেশাগত পরম্পরা। গামছা বিক্রি করে যে আয় হয় তাতে তাঁদের কোনোমতে চলে। কিন্তু পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখার গৌরবটুকু কোনোভাবে মলিন হতে দেবেন না তাঁরা। খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর গ্রামের কারিগরপাড়া। এই পাড়ায় প্রায় প্রতিটি পরিবার গামছা বুনে সংসার চালায়।

দেশজুড়ে রয়েছে এসব গামছার নামডাক। এখানে গামছা তৈরিতে রয়েছে বিশেষ শৈলী। লোকমুখে ছড়িয়েছে ফুলতলার গামছার কদর। এই গ্রামের গামছাশিল্পীরা নানা প্রতিকূলতায় ধরে রেখেছে সেই ঐতিহ্য। একসময় প্রতিটি পরিবারে তাঁত ছিল। এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু পাল্টে যাচ্ছে। ভোক্তার চাহিদা ও মানসিকতা বদলে গেছে। কিছুটা কমেছে গামছার কদর। তবে গামছা এখনো কম আয়ের এবং গ্রামীণ জীবনের নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী। উপকরণের দাম বাড়ায় গামছাশিল্প ও বুননশিল্পীরা রয়েছে টানাপড়েনে। তবু ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে গামছা বুনে চলেছে ফুলতলার বাসিন্দারা।

সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, নানা প্রতিকূলতার মধ্যে গামছাশিল্পের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এখানকার বাসিন্দরা। কারিগরপাড়ার এই গামছাশিল্পীদের পেশা বংশানুক্রমিক। পরিবারের প্রায় প্রত্যেক সদস্যই গামছা বুনতে পারে। বুননশিল্পী আবেজান বিবি (৬৫) বলেন, ‘সংসারের কাজের ফাঁকে গামছা বুনি। দিনে এক থান (চারটি) গামছা বুনতে পারি। আবার সময় বেশি পেলে বেশি গামছাও বুনতে পারি। এই গামছা লম্বায় চার হাত ও চওড়ায় দুই হাত। চারটি গামছা বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। এ ছাড়া লম্বায় সাড়ে তিন হাত ও চওড়ায় দেড় হাত গামছা চারটি বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। অনেক সময় রং, নকশা ও গুণগত মানের জন্য গামছার দামে হেরফের হয়।

এক থান বা চারটি গামছা বিক্রি করলে খরচ বাদ দিয়ে আয় হয় ১০০ টাকা। আগে আরো লাভ থাকত। ’ আবেজান বিবি শিশুবেলায় তাঁর বাবার বাড়ি থেকেই গামছা বুননের দক্ষতা আয়ত্ত করেন। বিয়ে হয় তেমনই একটি পরিবারে। পরিবারের সদস্যদের জন্য রান্না ও ঘরের অন্যান্য কাজ করেও তাঁর একটি প্রধান কাজ গামছা বোনা। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা হাটে-বাজারে ঘুরে সুতা কেনা, রং কেনা ও গামছা বিক্রির কাজ করে। তারা সুতায় রং ও নকশাও করে। তবে আজকাল অনেক ব্যবসায়ী বাড়ি বাড়ি ঘুরে গামছা কেনে।

গামছাশিল্পী আব্দুল মান্নান বলেন, ‘গামছা বুননের নকশা আমরা নিজেরাই করি। আমাদের এখানে বোনা গামছার নকশাগুলোর নাম—ঝুরি, চেক, ঝালকাঠি, লেডিস ইত্যাদি। অন্য এলাকার চেয়ে আমাদের বোনা গামছার জমিন আর পাড়ের রং ও নকশার মধ্যে আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। এ জন্য ফুলতলার গামছার আলাদা কদর ও নামডাক আছে। কিন্তু আজ আর টিকে থাকা যাচ্ছে না। ’ শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা গামছা বুনে ফুলতলা হাটে বিক্রি করি। এখানকার ফুলতলার বাজারে গামছার হাট বসে প্রতি রবি ও বুধবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত। পাইকার বা মহাজনরা এসব গামছা কিনে নিয়ে যায়। আবার অনেক সময় গামছা বুনে বাড়িতেই রেখে দিই। পাইকাররা বাড়িতে এসে গামছা কিনে নেয়। ’ সারা দিন শ্রম দিয়ে ১০০ টাকা আয়ে পোষায় না। পরিবারে দুজন সদস্য শ্রম দিলেও আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০০ টাকা।

অন্যদিকে মেশিনের তৈরি গামছার দাম কম, আবার চাহিদাও বেশি। এ কারণেই এখানকার তাঁতিরা গামছা বোনা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও দামোদর ও পাশের গ্রাম আলকায় পাঁচ শতাধিক তাঁত ছিল। এখন তাঁতের সংখ্যা কমে ২০০ থেকে ২৫০-এ নেমেছে। খরচ পোষাতে না পারায় গামছা বুননশিল্পীরা এখন ফুলতলা ও আশপাশের এলাকায় গড়ে ওঠা জুটমিলে কাজ নিয়েছে। এতে তারা গড়ে দিনে ৩০০ টাকা আয় করতে পারে। গামছাশিল্পীরা বলছে, উৎপাদনের খরচ বেশি অথচ গামছা দাম কম। আয় পর্যাপ্ত হয় না। অগত্যা আয়ের অন্য পথ খুঁজতে হয়। প্রয়োজনীয় সুতা ও রঙের দাম দিন দিন বাড়ছে। ফলে ফুলতলার গামছার ঐতিহ্য টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। সূত্র: কালের কন্ঠ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: