তরুণদের কাঁধে বাংলাদেশ, ইতিহাস বদলের হাতছানি!

প্রকাশিত: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০১:৪৬ এএম
বর্তমানে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান সেরা দশে। জঙ্গিবাদ থেকে শুরু করে নানা ধরণের অপকর্মের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এ দেশটিতে ২০০৯ সালের পর ক্রিকেট গড়াতে সময় লেগেছে প্রায় ১০ বছর। নিরাপত্তার অভাবে এ ১০ বছর পাকিস্তানে ক্রিকেট খেলতে যেতে বরাবরই অপরাগতা প্রকাশ করে এসেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলুড়ে দলগুলো। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কা দলের উপর অস্ত্র হামলার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সেই শ্রীলঙ্কাই প্রথম দেশ হিসেবে পাকিস্তানে খেলতে আসেন। তারপর দ্বিতীয় দল হিসেবে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপরই পাকিস্তান ক্রিকেট দল থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে পাকিস্তানে টেস্ট খেলতে অপরাগতা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। কোনো মূল্যেই পাকিস্তানে টেস্ট খেলতে যাবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। এরপরও বেশ কয়েকবার দর কষাকষি চললেও বিসিবি নিজের অবস্থানে অটল থেকেছে। কিন্তু দুবাইতে আইসিসির এক সভায় অংশগ্রহন করতে গেলে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সাথে আলোচনায় বসে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। টেবিলের খেলায় পরাজিত হয়ে পাকিস্তানে যেতে রাজি হয় বাংলাদেশ। ৩ ম্যাচ টি টোয়েন্টি, ২ ম্যাচ টেস্ট এবং ১ ওয়ানডে খেলতে পাকিস্তান যেতে রাজি হয় বাংলাদেশ। তবে খেলা হবে ৩ ধাপে। যার প্রথম ধাপে ৩ ম্যাচ টি টোয়েন্টি খেলতে পাকিস্তান যাবে বাংলাদেশ। টি টোয়েন্টি সিরিজ শেষে দেশে ফিরে আবার দ্বিতীয় ধাপে ১ টেস্ট খেলতে উড়াল দিবে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে এবং প্রথম টেস্টের পর দেশে ফিরে তৃতীয় বারের মতো ১ ওয়ানডে ও ১ টেস্ট খেলতে শেষবারের মতো পাকিস্তান যাবে তারা। অদ্ভুত এই সফরসূচির ইতোমধ্যে প্রথম ধাপ শেষ করে দ্বিতীয় ধাপে প্রথম টেস্ট খেলতে পাকিস্তানে অবস্থান করছে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা। টি টোয়েন্টি সিরিজে বাজেভাবে সিরিজ হারলেও নিরাপত্তার চাঁদরে ঢাকা ছিল খেলতে যাওয়া বাংলাদেশ দলের প্রতিটি প্রতিনিধি। এর আগে প্রায় ১৭ বছর পূর্বে অর্থাৎ ২০০৩ সালে পাকিস্তানে শেষবারের মতো টেস্ট খেলেছিল বাংলাদেশ। পাকিস্তানের মাটিতে এখন পর্যন্ত মোট ৪ টি টেস্ট খেলা হয়েছে বাংলাদেশ দলের। পাকিস্তানে খেলা প্রতিটি টেস্টেই বাংলাদেশকে হারের তিক্ত স্বাদ নিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে। ২০০১ সালের ২৯ শে আগস্ট প্রথম বারের মতো টেস্ট খেলতে পাকিস্তান যায় বাংলাদেশ। যেখানে বাংলাদেশের বিপক্ষে ইনিংস ব্যবধানে জয় তুলে নেয় ওয়াকার ইউনুসের পাকিস্তান। নাইমুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৩৪ রানে গুটিয়ে যায়। জবাবে পাঁচ পাকিস্তানি খেলোয়াড়ের সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশের সামনে পাহাড় গড়ে তোলে পাকিস্তান। ৩ উইকেটের বিনিময়ে ৫৪৬ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করে পাকিস্তান। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১৪৮ রান করতে পারে বাংলাদেশ। ইনিংস ব্যবধানে পরাজয়ের পর ২০০৩ সালে আবার টেস্ট খেলতে পাকিস্তান যায় খালেদ মাহমুদ সুজনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ। ২০ই আগস্ট করাচিতে প্রথম টেস্টে টস জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় পাকিস্তানি অধিনায়ক রশিদ লতিফ। প্রথম ইনিংসে হাবিবুল বাশারের সর্বোচ্চ ৭১ রানের ইনিংসের উপর ভর করে ২৮৮ রানে থামে বাংলাদেশের ইনিংস। প্রথম ইনিংসে ৩৪৬ রান করে অল আউট হয় পাকিস্তান। পাকিস্তানের হয়ে ইয়াসির হামিদ ১৭০ রানের এক দারুণ ইনিংস খেলেন। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের হয়ে ৩ টি করে উইকেট নেন 'নড়াইল এক্সপ্রেস' খ্যাত মাশরাফি বিন মর্তুজা এবং মোহাম্মদ রফিক। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে হাবিবুল বাশারের ১০৮ রানের ইনিংস বাংলাদেশকে ২৭৪ রানের সংগ্রহ এনে দেয়। ২১৭ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ইয়াসির হামিদের সেঞ্চুরিতে ৭ উইকেটের সহজ জয় পায় পাকিস্তান। দুই ইনিসে সেঞ্চুরি করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার পান পাকিস্তানের ইয়াসির হামিদ। ২৭ই আগস্ট দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে পেশওয়ারে মাঠে নামে বাংলাদেশ। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে ভালো সংগ্রহ করে বাংলাদেশ। জাভেদ ওমরের ১১৯ এবং হাবিবুল বাশারের ৯৭ রানের উপর ভর করে বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১০ উইকেটের বিনিময়ে ৩৬১। প্রথম ইনিংসে পাকিস্তানের হয়ে ৬ উইকেট নেন শোয়েব আকতার। জবাবে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ২৯৫ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের হয়ে ৩ উইকেট নেন অলোক কাপালি। ম্যাচের নিয়ন্ত্রন নিজেদের হাতে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৯৬ রানেই শেষ হয় বাংলাদেশের ইনিংস। পাকিস্তানি বোলারদের তোপে দিশেহারা হয়ে যায় বাংলাদেশ স্কোয়াড। ১৬৩ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ৯ উইকেটের বিশাল জয় পায় পাকিস্তান। তৃতীয় ও শেষ টেস্টে ৩রা সেপ্টেম্বর মুলতানে টস জিতে আবারও ব্যাটিং নেয় বাংলাদেশ। নিজেদের প্রথম ইনিংসে দলীয় প্রচেষ্টায় ২৮১ রান তোলে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ইনিংসটি খেলেন রাজিন সালেহ (৪৯)। ইনিংসে পাকিস্তানের হয়ে ৪ উইকেট পান উমর গুল। প্রথম ইনিসে বল করতে এসে পাকিস্তানকে ১৭৫ রানে গুঁটিয়ে দেয় টাইগাররা। বাংলাদেশের হয়ে রফিকের ঝুলিতে আসে পাঁচ উইকেট এবং অধিনায়ক সুজন পান চার উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে আবারও নড়বড়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ। ১৫৪ রানে অল আউট হয়ে আবারও হাত থেকে ম্যাচ ফোঁসকে যায় বাংলাদেশের। ২৬১ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে জয় পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে পাকিস্তানকে। ব্যক্তিগত ১৩৮ রান করে ইনজামামুল আউট হলে বেশ চাপে পড়ে পাকিস্তান। শেষ পর্যন্ত ১ উইকেটের কষ্টার্জিত জয় পায় পাকিস্তান। ২০০৩ সালের পর দীর্ঘ সময় পর আবার পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট খেলতে গেছে বাংলাদেশ। পূর্বের বাংলাদেশ দল আর বর্তমান বাংলাদেশ দলে পার্থক্যও ঢের। ক্রিকেটীয় জ্ঞানে বাংলাদেশ এখন পূর্বের তুলনায় কিছুটা উন্নত। যদিও টেস্টে বাংলাদেশের উন্নতি একেবারে যাচ্ছেতাই, কিন্তু দলে প্রতিভাবান তরুণদের উপর ভর করে বাংলাদেশ এবার ভালো কিছু করবে বলে মানছেন ক্রিকেট বিশ্লেষকরা। পাকিস্তানের সাথে এ পর্যন্ত মোট ১০ টি টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। যার ৯ টিতে হারের স্বাদ পেয়েছে এবং ১ টি ম্যাচ দেশের মাটিতে ড্র করেছে টাইগাররা। নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে এখন পর্যন্তও ১১৭ টেস্ট খেলা বাংলাদেশ, টেস্টে জয়ের দেখা পেয়েছে মোট ১৩ বার, হেরেছে ৮৮ বার এবং ড্র করেছে মোট ১৬ বার। সর্বশেষ ৫ টেস্টের সবক'টি ম্যাচেই হারের তিক্ততা পেয়েছে বাংলাদেশ। যার একটি ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে। টেস্টে সর্বশেষ বাংলাদেশের জয় ২০১৮ সালের নভেম্বর মাস। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মিরপুরে ইনিংস ব্যবধানে জয় পায় বাংলাদেশ। অপরদিকে নিজেদের খেলা সর্বশেষ টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাঠে জয় পেলেও, শেষ ৫ টেস্ট ম্যাচে পাকিস্তান হেরেছে মোট ৩ টি, ড্র করেছে ১টি এবং জয়ের দেখা পেয়েছে ১ টি ম্যাচে। আইসিসির সর্বশেষ টেস্ট র‍্যাংকিং অনুযায়ী টেস্টে বাংলাদেশের অবস্থান ৯ এবং পাকিস্তানের অবস্থান ৭। দু'দলের নিকট অতীত বিবেচনায় পাকিস্তানের থেকে কিছুটা পিছিয়ে থেকে মাঠে নামবে বাংলাদেশ। যার বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে দলের সেরা দুই অস্ত্র সাকিব ও মুশফিকের দলে না থাকা। জুয়াড়ির কাছে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়ে তা আইসিসিকে না জানানোর শাস্তি স্বরূপ ১ বছর ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ রয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। আর পারিবারিক কারণ দেখিয়ে নিরাপত্তার অভাবে পাকিস্তান সিরিজ থেকে নিজের নাম সরিয়ে নিয়েছে দেশসেরা ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে হারিয়ে খোঁজা মুস্তাফিজেরও জায়গা হয়নি পাকিস্তান সিরিজে। নিজেদের প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়ের পর বিশ্বকাপে যেয়ে হঠাৎ তাল হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। তারপর থেকে নানা জটিলতায় মাঠে এবং মাঠের বাইরে বাজে সময় পার করছে টাইগাররা। ধারাবাহিক ব্যর্থতায় যেন নিজেদের ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে পুরো দল। এমতাবস্থায় পাকিস্তানের মাঠে কাঙ্ক্ষিত জয়েই হতে পারে টাইগারদের ছন্দে ফেরার সূচনা। আর এরজন্য নিজেদের ঘাড়ে দায়িত্ব তুলে নিতে হবে দলে থাকা সকল প্রতিভাবান তরুণদের। সকল গ্লানি দূর করে তরুণদের কাঁধে ভর করে বাংলাদেশ ক্রিকেট এগিয়ে যাবে তার আপন মহিমায়, একটি ক্রিকেট পাগল জাতির এটাই প্রত্যাশা।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: