জলে গেল ৬ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০২০, ০৮:২৭ পিএম
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলরুট ব্রডগেজে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটা করতে গিয়ে সরকারের গচ্চা যাচ্ছে ছয় হাজার কোটি টাকা। অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের কারণে সদ্য স্থাপিত ১৩৪ কিমি. মিটারগেজ রেলপথ তুলে ফেলতে হবে। একই সঙ্গে সংস্কার করতে হবে রেল সেতুর। এছাড়া পুরনো নড়বড়ে ১৮৭ কিমি. রেলপথও পরিবর্তন করা হবে। এসব করতে গিয়ে সরকারকে বিশাল অংকের অর্থ গচ্চা দিতে হচ্ছে। অথচ সরকারের নতুন পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে সদ্য স্থাপিত লাইনগুলো মিটারের পরিবর্তে ডুয়েলগেজ করলেও এ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হতো। সারা দেশের রেলপথ নেটওয়ার্ককে ব্রডগেজের আওতায় আনা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সব মিটারগেজ রেললাইন তুলে দিয়ে ব্রডগেজ লাইন স্থাপন করা হবে। সারা বিশ্বে মিটারগেজ ইঞ্জিন, যাত্রীবাহী কোচ, লোহার রেল লাইনসহ যন্ত্রপাতির স্বল্পতার কারণেই সরকার ব্রডগেজে যাচ্ছে। মিটার গেজের লাইনগুলো মাপ হচ্ছে এক মিটার লাইনের ওজন ২৯ কেজি। সমপরিমাণ ব্রডগেজের লাইনের ওজন ৬০ কেজি বেশি। বিশ্বের সর্বত্রই ব্রডগেজ নেটওয়ার্কের কারণে মিটারগেজ লাইন পাওয়া যায় না। ব্রডগেজ স্লিপারের সাইজ হচ্ছে ৯ ফুট, মিটারগেজ ৬ ফুট। মিটারগেজ স্লিপার কোথাও তৈরি হচ্ছে না। ব্রডগেজ লাইনের মাপে ইঞ্জিন এবং যাত্রীবাহী কোচ তৈরি হচ্ছে। বিশ্বের কোথাও মিটারগেজ মাপের কোনো মালামালই পাওয়া যাচ্ছে না। মূলত এসব কারণে সরকার ব্রডগেজ নেওয়ার্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের বর্তমান লাইনগুলো তুলে ফেলা হবে। এপথে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে সদ্য বসানো ১৩৪ কিমি. লাইন পুরোটাই তুলে ফেলা হবে। ফলে এ পাঁচ হাজার কোটি টাকা পানিতে যাবে। এছাড়া পর্যায়ক্রমে অন্যগুলোও প্রতিস্থাপন হবে। এসব তুলে সরাতে ব্যয় হবে প্রায় হাজার কোটি টাকা। লোহার লাইন, স্লিপার, নাট-বল্টু কিছুই কাজে না লাগায় সব মিলে গচ্চার পরিমাণ দাঁড়াবে ছয় হাজার কোটি টাকা। এসব কাজ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষদের যেমন জনভোগান্তি বাড়বে, অন্যদিকে সরকারেরর গচ্ছা যাবে বিশাল অংকের টাকা। এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, পূর্বাঞ্চল রেলপথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ পথে ব্রডগেজ ডাবল লাইন নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। এ পথে যাত্রীসেবা বাড়াতে টঙ্গী-ভৈরব ও লাকসাম-চিনকি আস্তানা পর্যন্ত সিঙ্গেল মিটারগেজ লাইন স্থাপন করা হয়েছিল। নতুন এ রেলপথটি ভেঙে ফেলতে হবে। এপথে ব্রডগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এতে ব্যাপক ক্ষতি ও সরকারের অর্থ গচ্ছা যাবে স্বীকার করে তিনি বলেন, যে কোনো প্রকল্প নেয়ার আগে-সেই প্রকল্পের ভবিষৎ কী কী তা নিশ্চিত করতে হবে। উদ্বোধনের কয়েক বছর পরই নতুন রেলপথ ভাঙতে হচ্ছে- এটি খুবই দুঃখজনক। এটি আমাদের ব্যর্থতা। প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ভুল মানেই সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্ছা যাওয়া। সেবার বদলে ভোগান্তি। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, পূর্বাঞ্চল রেলপথে যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তা বাড়াতে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩৪ কিলোমিটার নতুন মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত প্রায় ৬৪ কিলোমিটার উদ্বোধন হয় ২০১৫ সালের ১৮ এপ্রিল। আর টঙ্গী থেকে ভৈরববাজার পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার উদ্বোধন হয় ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। এছাড়া এপথে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ভৈরব ও তিতাস নদীর উপর দ্বিতীয় রেলসেতু নির্মাণ করা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ৩২১ কিলোমিটারের মধ্যে ঢাকা থেকে টঙ্গী এবং চিনকি আস্তানা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ১২৮ কিমি. পথ খুবই দুর্বল। এ লাইন সবল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এবার রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভুলের কারণে এপথ ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক গোলাম মোস্তফা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসন অনুযায়ী কোথাও আর মিটারগেজ রেললাইন নির্মাণ করা যাবে না। ঢাকা চট্টগ্রাম রেলপথে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প আরও ১ যুগ আগেই নেয়া উচিত ছিল। ওই পথে মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ করায় তা ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। নতুন রেলপথ ভেঙেই টঙ্গী-ভৈরববাজার, লাকসাম-চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের সমীক্ষা শেষ হয়েছে। নতুন মিটারগেজ লাইন নির্মাণে ব্যয় হওয়া ৫ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে এ লাইন ভাঙতে, সরাতে আরও হাজার কোটি টাকার উপরে ব্যয় হবে। অনুশাসন অনুযায়ী যেহেতু কোথাও মিটারগেজ লাইন নির্মাণ করা যাবে না- সেই ক্ষেত্রে ভাঙা রেলপথের মালামাল কোথায় কী করে কতটুকু কাজে লাগবে তা বলা যাচ্ছে না। ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণে প্রাথমিক ভাবে ব্যয় ধরা হচ্ছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। সূত্র জানায়, ট্রেনের গতি বাড়ানোর জন্য নতুন দুটি রেলপথ বসানো হয়। কিন্তু সরেজমিন দেখা গেছে, এপথে ট্রেনের গতি, যাত্রীসেবা এবং নিরাপত্তা বাড়েনি। প্রতিশ্রুতি ছিল ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি নতুন লাইন দিয়ে ১১০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো যাবে কিন্তু সেই আশা এখনও পূরণ হয়নি। ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় নিয়মে দাঁড়িয়েছে। এক যুগ আগে এ পথে যেসব ট্রেন ৬৫ থেকে ৭৫ কিলোমিটার গতি নিয়ে চলত- বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার গতিতেই ট্রেন চলছে। রেলপথ নতুন হলেও আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ইঞ্জিন ও যাত্রীবাহী কোচগুলো দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। প্রকল্প গ্রহণের আগে কিংবা সঙ্গে সঙ্গে নতুন রেল ইঞ্জিন ও যাত্রীবাহী বগি সংগ্রহের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অভিযোগ আছে, ইঞ্জিন ও কোচ সংগ্রহের চেয়ে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নে তৎপর থাকেন রেলের অসাধু কর্মকর্তারা। বর্তমানে রেলে ৩৮টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রায় সবক’টি প্রকল্পই খুঁড়িয়ে চলছে। ফাঁকফোকর রেখে যেসব রেলপথ তৈরি করা হয়েছিল, সেই সব পথ ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। আর এতেই বেশ খুশি রেলওয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের চক্রটি। যারা একের পর এক প্রকল্প গ্রহণ করছেন। কিন্ত সরকারের পরিকল্পনার সঙ্গে কোনো মিল রাখছেন না। ঢাকা চট্টগ্রাম পথে নতুন করে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণের জন্য সমীক্ষার কাজও শেষ হয়েছে। টঙ্গী থেকে ভৈরব হয়ে আখাউড়া এবং লাকসাম হতে চিনকি আস্তানা।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: