মহামারীতেও বিবাহ বিচ্ছেদের হিড়িক

প্রকাশিত: ২৮ ডিসেম্বর ২০২০, ০৩:০৫ পিএম
জিন্নাতুন নূর: মহামারীর মধ্যেও রাজধানী ঢাকায় বিবাহ বিচ্ছেদের হিড়িক পড়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের হিসাব বলছে, গত জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ঢাকায় বিবাহ বিচ্ছেদের হার ২০১৯ সালের একই সময়ের চেয়েও প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। এই সময়ে প্রতিদিন গড়ে ৩৯টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর গত মার্চ ও মে মাসে তুলনামূলক কম বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ে। এপ্রিলে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দুই সিটিতেই কোনো আবেদন জমা পড়েনি। তবে লকডাউন তুলে নিতেই জুন মাস থেকে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বিচ্ছেদের আবেদনের মধ্যে কারণ হিসেবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়া, মনের অমিল, শারীরিক নির্যাতন এবং একে অপরকে সম্মান না করার কথা উল্লেখ থাকে। পারিবারিক অসহযোগিতাও বিচ্ছেদ বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ বলে জানা গেছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তালাক হয়েছে ৫ হাজার ৯৭০টি। এর মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনে ২ হাজার ৭০৬টি আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৩ হাজার ২৬৪টি তালাক হয়েছে। এই সময়ে প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার ১৯৪টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে প্রতি মাসে গড়ে তালাক হয়েছিল ৯২০টি। চলতি বছরের জুন-অক্টোবর এই পাঁচ মাসে তালাক বেড়েছে ২৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর আগে বছরের শুরুতে জানুয়ারিতে বিচ্ছেদের হার বেশি থাকলেও ধীরে ধীরে এই সংখ্যা কমে আসে। জানুয়ারিতে উত্তর সিটি করপোরেশনে ৬১৮, ফেব্রুয়ারিতে ৪৪১ জন, মার্চে ৪৫৫ জন বিচ্ছেদের আবেদন করেন। মে মাসে ৫৪টি এবং জুন মাসে জনজীবন কিছুটা স্বাভাবিক হলে এই সংখ্যা বেড়ে ৬৩২ জনে দাঁড়ায়। একইভাবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে জানুয়ারিতে ৫২৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৪২ জন, মার্চে ৪৯২ জন বিচ্ছেদের আবেদন করেন। মে মাসে ১১৩ জন ও জুনে ৪৪১ জন বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন। উত্তর ও দক্ষিণে আবেদনকৃত নারী-পুরুষের মধ্যে নারীরা পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ হারে বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন। আবেদনকারীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৩০ শতাংশ এবং নারীর ৭০ শতাংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিনাত হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মহামারীতে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম একটি হতে পারে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা। লকডাউনের পর স্বামী-স্ত্রী অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। এ সময়ে অনেকেই ব্যয়ভার বইতে না পেরে গ্রামে চলে গেছেন। আবার অর্থনৈতিক চাপ সইতে না পেরে অনেকেই বিচ্ছেদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ, অর্থনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে সহনশীলতাও জড়িত। আবার স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য দীর্ঘ সময় একসঙ্গে ঘরে থাকায় অনেকের ওপরই মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়েছে। এতে পরিবারগুলো এক ধরনের সাংঘর্ষিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। যা শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদে গড়ায়। মহামারীতে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো কন্যা সন্তানদের বাল্যবিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। এই বাল্যবিয়ের ফলে সেই পরিবারগুলোতে পারিবারিক অসহযোগিতা থেকেও বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩ এ গুলশান, বনানী ও মহাখালীতে সাধারণত উচ্চবিত্ত-সচ্ছল নাগরিকদের বসবাস। এই অঞ্চলে গত কয়েক মাসে ৬০০-এর বেশি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে মাত্র ১৭টি আবেদন নিষ্পত্তি হয়। যার ৪০০-এর বেশি অর্থাৎ ৮০ শতাংশ আবেদনই করেন নারীরা। অঞ্চল-৩ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল বাকী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান আমরা পেয়েছি সেখানে আবেদনকারীদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী। পারিবারিক সহনশীলতা থেকে আমরা ক্রমেই দূরে চলে যাচ্ছি। নিজেদের মধ্যে একটু মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতাও কমে আসছে। যা ভবিষ্যতে একটি সামাজিক সমস্যায় পরিণত হতে পারে। সাধারণত মেয়ের পক্ষ লোকজন যখন সিটি করপোরেশনে শুনানির জন্য যান তখন বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, খেয়াল না রাখার বিষয়গুলো উল্লেখ করেন। অনেকে আবার সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবের কথাও বলেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের জন্য পারিবারিক কলহই দায়ী। বিশেষ করে ছেলে পক্ষের অভিভাবকদের নির্যাতনের বিষয়টিও উঠে এসেছে। ছেলেদের ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে স্ত্রীর উচ্ছৃঙ্খল আচরণকে দায়ী করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে মেয়েদের পারিবারিক স্ট্যাটাস বেশি বলেও অনেকে মানিয়ে নিতে পারেন না। কেউ কেউ স্ত্রীর স্বাধীনচেতা মনোভাবকে বিচ্ছেদের কারণ বলে উল্লেখ করেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-২ এ নন্দীপাড়া, মাদারটেক, মেরাদিয়ায় সাধারণত নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারের জনবসতি। কিন্তু এই এলাকাতেও বিচ্ছেদের জন্য যে আবেদন করা হচ্ছে তা উল্লেখযোগ্য এবং এদের মধ্যে শতকরা ৭০ শতাংশ নারী বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন। মাত্র হাতে গোনা কিছু ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ প্রত্যাহারের আবেদন আসে আর আবার তালাক প্রত্যাহার করার যে আবেদন আসে সেখানেও নারী এগিয়ে। দক্ষিণের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা-২ সুয়ে মেন জো বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিচ্ছেদের আবেদন জমা দেওয়ার পর কেউ যদি আমাদের কাছে প্রত্যাহার করার জন্য আসেন তাহলে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু শুনানির জন্য আমরা কোনো পক্ষকেই পাই না। যারা বিচ্ছেদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেন তারা কাজি অফিসের মাধ্যমে আমাদের কাছে বিচ্ছেদের আবেদন পাঠানোর পর পরবর্তী ৯০ দিনে আর হাজিরার জন্য আসেন না। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: