আপনার কোমলপ্রাণ শিশুটির শৈশবকে নিজ হাতে গলা টিপে হত্যা করছেন না তো !

প্রকাশিত: ০৩ জানুয়ারি ২০২১, ০৭:০৪ পিএম
প্যানডেমিক পরিস্থিতির বিচারে আমাদের শিশুরা যে ভাল নেই সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। স্কুল বন্ধ। অনলাইনে ক্লাস চললেও নির্দিষ্ট সংখ্যাক শিশুরা সে সুযোগ পাচ্ছে কিন্তু সিংহভাগ শিশুই বিভিন্ন কারনে তা থেকে বন্চিত আছে। কেউ অনলাইনে ক্লাস করার ডিভাইস পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। কাউকে কাউকে কোনপ্রকারে ম্যানেজ করতে হচ্ছে একটা ভালো স্মার্টফোন নয়ত ল্যাপটপ। এই করতে গিয়ে হয়ত অভিভাবকদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। পেনডামিক এর আগেও শিশুদের ক্ষেত্রে শোনা যেত তারা বইয়ের চাপে, হোমওয়ার্কের চাপে, ভালো রেজাল্টের চাপে দিশেহারা। তাদের খেলার মাঠ নেই, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে সঠিক সৃষ্টিশীলতার চর্চা নেই। তারপরও কোনমতে চলে যাচ্ছিল আমাদের শিশুরা। এবার মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে সেলিব্রেটি হবার প্রতিযোগিতা। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যপার হল এই প্রতিযোগিতায় অভিভাবক এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও সামিল হচ্ছে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে।এখন অনলাইনে শিশুদের চাহিদা আছে জেনে নিজ শিশুসন্তান কে ব্যবসায়িক কাজেও লাগাচ্ছেন অনেকে। বিশেষ করে যে পিতামাতা (হয়তো ) জীবনে সেলিব্রেটি হতে চেয়েছিল অথচ তারা সেটা হতে পারেনি, তারা রাতারাতি খ্যাতি পাওয়ার উন্মাদ বাসনায় তাদের শিশুদের এসবে উৎসাহী করে তুলছেন। বাবা-মায়ের লোভ কিংবা ইচ্ছার বলি হতে গিয়ে তারা হারিয়ে ফেলছে তাদের সোনালী শৈশব। অল্প পরিশ্রমে খ্যাতি পাওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠছে। খ্যাতি থেকে তাদের মনোজগতে আসছে বিরাট পরিবর্তন। তারা বদমেজাজি, দুর্বিনীত, ঘুমের সমস্যায় ভোগা, ও হিংস্র হয়ে উঠছে। দীর্ঘসময় অনলাইনে থাকা, অপরিচিত মানুষের সাথে যোগাযোগ এসবে তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হতে যাচ্ছে ফলে বিভিন্ন অপরাধ চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়া, নেশায় আসক্ত হওয়া এসবের সম্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে চরম হারে। এখনকার বেশিরভাগ বাচ্চারা তাদের জীবনে হেরে যাওয়ার স্বাদ কিংবা সময় নিয়ে কষ্ঠ করে কিছু অর্জন করার স্বাদ নিতে রাজী না। তারা ইউটিউবার হবে কারন এতে কষ্ট কম লাভ বেশি। ক্রিয়েটিভ কোন কাজে তাদের এখন আর মন নেই। বাবা মা রা এ ভূলে গেছেন যে, একটা বাচ্চা যখন বাইরে খেলতে যাবে কিংবা যে সময় টা এই ইন্টারনেট কিংবা ভিডিওস বানানোর পিছনে নষ্ট করবে সে সময়টায় অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করলে এরা নিজেদের এক্সপ্লোর করতে পারবে, নিজেকে আবিস্কার করবে নতুন নতুনভাবে। এসময় এরা একে অন্যের কাছে হারবে একবার, জিতবে একবার। যখন হারবে তখন আপ্রান চেষ্টা করবে কিভাবে জেতা যায়, একে অন্যের সাথে জয়ের জন্য বিভিন্ন আইডিয়া খুঁজবে এবং শেয়ার করবে, কোন সমস্যায় পরলে সেখান থেকে বের হওয়ার উপায় বের করবে সবাই মিলে যা কিনা একটা বাচ্চার মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে অপ্রতুল সাহায্য করে। এ থেকে এরা লং টার্ম ও শর্ট টার্ম গোল গুলো ও কিভাবে অর্জন করতে হয় সে ধারনা না চাইতে ও পেয়ে যাচ্ছে। অতচ এখন দেখা যাচ্ছে একটা ১২/১৩ বছর কিংবা তার চেয়েও বয়সে ছোট ছেলে মেয়ে যারা কিনা ক্লাস সিক্স সেভেন কিংবা তারও ছোট ক্লাসে পড়ে, সে সব ছেলেমেয়েরা কসমেটিকস সহ বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করছে। এগুলোর দাম কত, কখন, কোথায়, কিভাবে পাওয়া যাবে সেগুলো ও বলে দিচ্ছে বেশ পেশাদার ভাবভঙ্গিতে। মেকাপ ভিডিওস বানাচ্ছে এতটুকুন বাচ্চা মেয়ে। শুধু কি তাই? ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়েদের দেখা যায় টিকটক বানাতে বিভিন্ন অশ্লীল অংগ ভংগীমায়। ছোট ছোট নাটক করে এরা ইউটিউব এ যেখানে দেখা যায় ছোট ছোট বাচ্চারা প্রেমের মিথ্যে অভিনয় করে ঠকাচ্ছে তার পার্টনারকে, বউ শাশুড়ী সেজে একে অপরের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে।বর্ন বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। পরকিয়া করছে একে অপরের সাথে, একে অন্যের সংসার ভাংগছে। কেউ যদি এর সমাধান দেন এই বলে যে, এরা বাচ্চা মানুষ, আনন্দ করছে এসব ভিডিও করে। নিশ্চয়ই এটা ভূল সমাধান। এসমস্ত বিষয় আনন্দের বিষয় না। বরং এটা চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে পরিবার তথা সমাজে। কারন এদের একদল দর্শক আছেন যারা গোগ্রাসে গিলেন এসব এবং সাথে তাদের বাচ্চা কাচ্চারা ও থাকে। ব্যপারটা কি খুবই সহজ মনে হচ্ছে? একদমই না। এর ফলে আমরা পেতে যাচ্ছি একটা ইঁচড়েপাকা, মেধাহীন পরবর্তী জেনারেশন। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। বলতে পারেন বাচ্চারা এই লকডাউনে ঘরে বসে করবে কি? বেশ। ঘরে বসে এদের কবিতা আবৃত্তি করান, হাতে একটা গল্পের বই দেন, গান শিখান, গিটার বাজানো শিখান, রান্না শিখান, বেকিং শিখান, আঁকাজোকা করান। তাও বেচাবিক্রি করাবেননা নিজের সন্তানকে দিয়ে। আর নিজেরা পাশে বসে গাইড করবেননা সেসব! যদি করেন তবে খুব বেশিদিন আর নাই আমরা যখন দেখবো যে অনলাইনে শাড়ি-জামা, জুতা,গয়না থেকে শুরু করে সমস্ত জিনিসপত্র ফেরি করতে আসছে আমাদেরই শিশুরা। কেন? কারণ শিশুদের ইউটিউব ভিডিও, হোক সে যেকোন ভিডিও, এতে লাইক, ভিউ বেশি। মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে তাড়াতাড়ি, পেইজগুলো তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাচ্ছে দ্রুততম সময়ে। তাছাড়া ছেলেমেয়েরা সেলিব্রেটি হয়ে যাচ্ছে। এই সব সেলিব্রেটির চক্করে পরে, আপনার মনোবাসনা পূরন করতে গিয়ে নিজের সন্তানকে, তার ভবিষ্যতকে পংগু বানাবেননা। দয়া করে তাদের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিবেননা। তাদের কোমলপ্রাণ শৈশবকে নিজ হাতে গলা টিপে হত্যা করবেননা। অভিভাবকদের জন্য একটা কথাই থাকবে, এই যে আপনি নিজের সন্তানকে বিনা পরিশ্রমে সেলিব্রেটি বানাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন, আপনি কি জানেন পৃথিবী বিখ্যাত সেলিব্রেটিদের সন্তানদের তারা নিজেরাই এসব জগত থেকে দূরে রাখেন? আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা তার মেয়েকে একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরেই কেবল সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢোকার অনুমতি দিয়েছিলেন! এমনকি Facebook's Palihapitiya নিজে ও সমান কথাটাই শেয়ার করেছে যে সে তার সন্তানকে বলেছেন, "You go figure it out, go outside, skin your knee, fall on the ground, play a sport, lose at something, and then come back to me and we'll talk about it." তাহলে আপনি আর কিসের অপেক্ষা করছেন? আজই নিজের সন্তানকে অন্ধকার জগত থেকে ফেরান, তাদের খেলতে দেন সমবয়সীদের সাথে। উপভোগ করতে দিন তাদের নিজের জগতকে। [খোলা কলামে প্রকাশিত সকল লেখার দায়দায়িত্ব একান্তই লেখকের নিজের। এর সাথে পত্রিকার কর্তৃপক্ষের কোন সম্পর্ক নেই।]

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: