পুলিশ যে ক্ষমতায় গ্রেফতার করতে পারে, আটক হলে যা করণীয়

প্রকাশিত: ২৮ জানুয়ারি ২০২১, ০৫:৫৬ পিএম
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে মুক্ত স্বাধীন জীবন যাপনের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকেরই আছে। এটি একটি মৌলিক অধিকার। কিন্তু এ দায়বদ্ধতা আমাদের সংবিধান আদৌ রক্ষা করতে পারছে না। যুগের পর যুগ শুধু ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তারের ক্ষমতা স্বেচ্ছাচারীভাবে প্রয়োগ হয়ে আসছে।আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বা অন্যান্য প্রয়োজনে পুলিশ বিভিন্ন অভিযানে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের আটক করে। তবে কোনো অভিযোগ ছাড়া ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় কাউকে আটক করে রাখতে পারে না। গ্রেফতার ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে ছেড়ে দিতে হয় বা কোনো আইনের আওতায় তাকে গ্রেফতার দেখাতে হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা ওয়ারেন্ট ছাড়া আমল-অযোগ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে কোনো অপরাধের জন্য গ্রেফতার করতে পারেন না পুলিশ। কিন্তু আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার ক্ষমতাবলে ৯টি কারণে পুলিশ যে কাউকে বিনা পরোয়ানায় বা আদেশ ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারে। আমলযোগ্য অপরাধ হলো- যে সব অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারে (দ্বিতীয় তফসিল; ও ৪ (চ) ধারা) এবং আমল-অযোগ্য অপরাধ হলো- যে সব অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তা অপরাধীকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারে না ( ফৌ: কা: এর ৪ (ঢ) ধারা)। যদিও ফৌজদারি কার্যবিধির এই ৫৪ ধারার ব্যাপারে সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিকতার ব্যাপারে হাইকোর্টের রায়ে পর্যবেক্ষণ এসেছে। তবে আমরা সেই বিষয়ে আলোচনায় না গিয়ে পুলিশের বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারি এবং আটককৃত ব্যক্তির আইনগত অধিকারের বিষয়টি জানবো। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় যে ৯টি কারণে একজন পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত গ্রেফতার করতে পারেন। ক. আমলযোগ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি অথবা যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত অভিযোগ রয়েছে কিংবা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া গেছে, বা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ রয়েছে। খ. আইনসংগত কারণ ব্যতীত যার নিকট ঘর ভাঙ্গার কোনো সরঞ্জাম রয়েছে এমন ব্যক্তি। গ. অত্র কার্যবিধি কিংবা সরকারের আদেশ দ্বারা যাকে অপরাধী ঘোষণা করা হয়েছে। ঘ. চোরাইমাল যার কাছে পাওয়া যায়। ঙ. পুলিশ কর্মকর্তার কাজে বাধাদানকারী; হেফাজত হতে পলায়নকারী বা পলায়নের চেষ্টাকারী ব্যক্তি। চ. সশস্ত্র বাহিনী হতে পলায়নকারী। ছ. দেশের ভিতর যে সব কাজ শাস্তিযোগ্য দেশের বাহিরে করা হয়েছে তেমন কাজ। জ. কোনো মুক্তিপ্রাপ্ত আসামি যে অত্র কার্যবিধির ৫৬৫ (৩) উপধারা লঙ্ঘন করেছে। ঝ. গ্রেফতারের জন্য পুলিশের কাছ থেকে অনুরোধ পত্র আছে। এই ৯টি ক্ষেত্রে পুলিশকে বিপুল ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এমন ৯টি কারণে আটককৃত ব্যক্তির কেমন অধিকার রয়েছে সেই বিষয়ে আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ের ৩৩ (১) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- গ্রেফতারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করে প্রহরায় আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ ও তার আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না।’ ৩৩ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- গ্রেফতারকৃত ও প্রহরায় আটক ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে (গ্রেফতারের স্থান থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাকে তদতিরিক্ত প্রহরায় আটক রাখা যাবে না।’ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের বর্ণিত অধিকারের মধ্যে ফৌ: কা: ৬০ ধারায় আটককারী পুলিশ কর্মকর্তা আটককৃত ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অর্পণ এবং ৬১টি ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ব্যতীত আটককৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় আটক না রাখার বিধান বর্ণিত হয়েছে। ৫৪ ধারায় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে স্বাভাবিকভাবে নন জিআর মামলা হিসেবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করতে হয়। এরপর আদালত একজন আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন প্রদান করে থাকেন। এক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তা যদি কোনো প্রতারণার আশ্রয় প্রশ্রয় নিয়ে আটক করেন সেক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার সুযোগ রয়েছে। আর যদি আইনসংগত উপায়ে পুলিশ কর্মকর্তা আটক করেন সে ক্ষেত্রে আদালত যুক্তিযুক্ত বিষয়াদি বিবেচনা করে আটককৃত ব্যক্তিকে কারাগারে প্রেরণ নতুবা তৎক্ষণাৎ মুক্তি দিতে পারেন। বিগত ২০০৩ সালে ৭ এপ্রিল তারিখে ৫৪ ও ১৬৭ ধারায় গ্রেফতার ও রিমান্ডের বিষয়ে ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশে মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ বিস্তারিত আলোচনা শেষে ও কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ২৫ মে হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া রায় বহাল রেখে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে দেওয়া হয়। হাইকোর্টের রায়ে যে সব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিলে সেগুলো হলো- ক. আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না। খ. কাউকে গ্রেফতার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ. গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে এর কারণ জানাতে হবে। ঘ. বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে। ঙ. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে তার পছন্দমতো আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে। চ. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের ভেতরে কাচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবে। ছ. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। ট. পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে পেনাল কোডের ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: