১৭০ টাকার ইঞ্জেকশন কেনা ২২১০ টাকায়

প্রকাশিত: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৩:৪৩ পিএম
তৌফিক মারুফ: দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অনেক ধরনের ওষুধের মধ্যে কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন মেরোপেনাম। কভিড হাসপাতালগুলোতে এই ওষুধ যেন অপরিহার্য হয়ে ওঠে। ইঞ্জেকশনটি আগে থেকেই দেশে উৎপাদিত হয়ে আসছে। বেসরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানও এই ইঞ্জেকশন উৎপাদন করে। করোনার সময়ে এর চাহিদার কারণে দেশে উৎপাদনও বেড়ে যায় আগের তুলনায় অনেক বেশি। তবে এই সময়ে অনেক কিছুর আড়ালে এই অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন নিয়েও ঘটে গেছে বড় ধরনের কেলেঙ্কারি। গত বছর মার্চে দেশে কভিড সংক্রমণ ধরা পড়ার পর থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এই ইঞ্জেকশন কেনা হয়। দেশে সরকারি ও বেসরকারিভাবে উৎপাদিত সব কম্পানির মেরোপেনাম ইঞ্জেকশনের গুণ ও মান এক থাকলেও সরকারি আটটি হাসপাতালে এই ওষুধ কেনা হয়েছে দামের আকাশ-পাতাল ব্যবধানে। ১৭০ টাকা দামের ওষুধ কোনো কোনো সরকারি হাসপাতাল কিনেছে দুই হাজার ২১০ টাকা করেও। অস্বাভাবিক বেশি দামে কেনার পাশাপাশি অস্বাভাবিক মজুদেরও ঘটনা ঘটেছে। শুধু সরকারি হাসপাতালে অস্বাভাবিক দামে কেনাই নয়, সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান এই ইঞ্জেকশন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করেছে, যা নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অডিট শাখা থেকে এরই মধ্যে আপত্তি তোলা হয়েছে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে তদন্ত কার্যক্রম। স্বাস্থ্য অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মহামারিকে পুঁজি করে অনেক ধরনের দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে। ওষুধের দামের ঘটনাটি এরই একটি অংশমাত্র। এ ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক ধরনের দায় রয়েছে। বিশেষ করে আইপি (ইন্ডিকেটেড প্রাইজ) নিয়ে বরাবরই এক ধরনের নৈরাজ্য চলে দেশের ওষুধের বাজারে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। মেরোপেনামের ক্ষেত্রে এই আইপির সুযোগ নিয়ে নয়ছয় করা হয়েছে।’ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঢাকার ৯টি সরকারি হাসপাতালে মেরোপেনাম ইঞ্জেকশন কেনাকাটার অডিট করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। অন্যদিকে একমাত্র সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগ কম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) উৎপাদন বন্ধের কারসাজির বিষয়টিও তাদের নজরে এসেছে। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বেসরকারি উৎপাদনকারীদের সুবিধা দিতে এ কাজটি করা হয়েছে। অডিট আপত্তি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবের প্রতিবেদন অনুসারে দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে উৎপাদিত মেরোপেনাম গ্রুপের সব কয়টি ব্র্যান্ডের ওষুধের গুণ ও মান একই; কোনো পার্থক্য নেই। তা সত্ত্বেও যে মেরোপেনাম ইঞ্জেকশন (এক এমজি) প্রতি ডোজ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কোনো একটি কম্পানির কাছ থেকে ১৭০ টাকা ৮০ পয়সা দরে কিনেছে, আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কিনেছে ২৪০ টাকা দরে। সেখানে একই ওষুধ কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল কিনেছে কখনো দুই হাজার ২১০ টাকায়, কখনো এক হাজার ৯৫৫ টাকায়, কখনো এক হাজার ৩৫০ টাকায়, আবার কখনো এক হাজার ৩০০ টাকায়। মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এই ওষুধ প্রতি ডোজ কিনেছে এক হাজার ২৯৮ টাকা দরে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কিনেছে এক হাজার ২৯৫ টাকা দরে। অডিট প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে আরেক অস্বাভাবিক কাণ্ড করেছে ইডিসিএল। যে ওষুধ প্রাইভেট কম্পানি বিক্রি করেছে ১৭০ বা ২৪০ টাকায়, সেই ওষুধ এই সরকারি প্রতিষ্ঠানটি সরকারি হাসপাতালের কাছেই বিক্রি করেছে ৭৯৩ টাকা ২৮ পয়সা দরে। অডিট প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, গুণমান একই হওয়া সত্ত্বেও যে ওষুধ প্রাইভেট কম্পানি ১৭০-২৪০ টাকায় বিক্রি করতে পারে, সেই ওষুধ কেন সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান তিন-পাঁচ গুণ বেশি দামে বিক্রি করবে; সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওষুধের দাম তো সরকারি হাসপাতালের জন্য আরো কম হওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, যে প্রতিষ্ঠান সরাসরি নিজেরা ওষুধ কিনেছে, সেখানে দাম কম পড়েছে, কিন্তু কয়েকটি হাসপাতাল ঠিকাদারের মাধ্যমে ওষুধটি কিনেছে কয়েক গুণ বেশি দামে। আর এই সুযোগে অপ্রয়োজনেও বেশি কিনে ওষুধ মজুদ করার মাধ্যমে বিশেষ লাভবান হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে পরামর্শ হিসেবে বলা হয়েছে, এ ধরনের কেনাকাটায় প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি কেনাকাটা করলে সরকারের অর্থের সাশ্রয় হয়, দুর্নীতি ও অপচয় কম হয়। এ অভিযোগ প্রসঙ্গে ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. এহসানুল হক জগলুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের মেরোপেনামের দাম ৭৯৩ টাকা ঔষধ প্রশাসন থেকেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা এ ক্ষেত্রে মাত্র ৫-৭ শতাংশ লাভ করতে পারি। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও আমাদের কোনো সাবসিডি নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রাইভেট কম্পানিগুলো অনেক সময় প্রতিযোগিতার কারণে দাম কমবেশি করতে পারে, কিন্তু আমাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না।’ ইডিসিএলে এই ইঞ্জেকশনের উৎপাদন বন্ধ থাকার তথ্য ঠিক নয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘করোনার সময় তো দূরের কথা, কখনোই আমাদের কম্পানির উৎপাদন বন্ধ থাকেনি।’ সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. ফরিদ উদ্দিন মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কেনাকাটার দায়িত্ব প্রতিটি হাসপাতালের। তারা যদি এ ক্ষেত্রে পিপিআরের কোনো ব্যত্যয় ঘটিয়ে থাকে তবে তো অবশ্যই তাদের জবাবদিহির আওতায় আসতে হবে। যদিও এখন পর্যন্ত এসংক্রান্ত দায়িত্ব আমার শাখা পর্যন্ত আসেনি।’ সূত্র: কালের কন্ঠ।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: