‘যত লাভের স্বপ্ন দেখে তামাক চাষে এসেছি বাস্তবতা তত সুখময় নয়’

প্রকাশিত: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০২:৩৭ এএম
‘বিষবৃক্ষ’ তামাক চাষ দখল করে নিয়েছে বান্দরবানের লামা উপজেলার প্রায় ৯০ ভাগ আবাদী জমি। আবাদী জমি সহ স্কুল মাঠ, বসতবাড়ির আঙ্গিনা, নদীর দু’পাড়, সমতল ভূমি, পাহাড়ি ঢালু জমি ও সরকারী রিজার্ভ এলাকায় সর্বত্র এখন তামাক চাষের দখলে। তামাক চাষে কোম্পানি কর্তৃক প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকায় দিনে দিনে বাড়ছে মরণ চাষ তামাকের চাষাবাদ। জানা যায়, ১৯৮৪ সাল থেকে বহুজাতিক তামাক কোম্পানি বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি বাংলাদেশ এর হাত ধরে লামা উপজেলায় তামাক চাষ শুরু হয়। তারপরে একে একে আলফা টোব্যাকো, রাঙ্গুনিয়া টোব্যাকো, ঢাকা টোব্যাকো (বর্তমানে ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো), আবুল খায়ের, নিউ. এজ টোব্যাকো তামাক চাষ শুরু করে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, তামাক বিক্রয়ের নিশ্চয়তা থাকায় ও অল্প সময়ে লাভবান হতে অন্যান্য ফসলের চাষাবাদ ছেড়ে তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছেন এ অঞ্চলের অধিকাংশ চাষীরা। তামাক চাষে যতই লাভের স্বপ্ন তামাক চাষীরা দেখেছেন তাদের সেই আশা দু-স্বপ্নই থেকে গেছে ৩ যুগ ধরে। লামা পৌরসভার সাবেক বিলছড়ি এলাকার তামাক চাষী মোঃ কামাল, মংএচিং মার্মা, সিলেটি পাড়ার তামাক চাষী নীল মিয়া, জহির ইসলাম সহ অনেকে দুই যুগ ধরে তামাক চাষে জড়িত। তাদের অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায়, কোন বছর লাভ হলে পরের বছর আবার লোকসান। এক বছর তামাকের দাম ভালো থাকলে পরের বছর নানা অজুহাতে তামাকের বাজারে ধস নামে। তামাকে লোকসানে পড়ে অনেক চাষী ঋণে জর্জরিত হয়ে এলাকা ছেড়েছে। যত লাভের স্বপ্ন দেখে আমরা তামাক চাষে এসেছি বাস্তবতা তত সুখময় নয়। শুধুমাত্র বিক্রয়ের নিশ্চয়তা থাকায় মানুষ তামাক চাষে ঝুঁকছে। ধান সহ অন্যান্য ফসলে বিক্রয়ের নিশ্চয়তা থাকলে আমরা তামাক ছেড়ে ফসল চাষাবাদে ঝুঁকতাম। সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, লামা উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়নে ৯০ শতাংশ জমি তামাক চাষের দখলে। তামাকের আগ্রাসন এতটাই বেড়েছে যে, লামা পৌরসভার সাবেক বিলছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ অনেক বিদ্যালয়ে প্রাঙ্গনে তামাক চাষ হচ্ছে। সাবেক বিলছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোল ঘেঁষে ৩ দিকে তামাক চাষ করেছেন তামাক চাষী মোঃ খোরশেদ আলম। সে সিলেটি পাড়ার ফিরোজ মিয়ার ছেলে। তিনি জানান, আমি এই জমি বর্গা নিয়ে তামাক চাষ করেছি। জমির মালিক কেন তামাক চাষ করতে দিল সেটা সে বলতে পারবে। এই বিষয়ে জানতে জমির মালিক লামা পৌরসভার বড় নুনারবিল মার্মা পাড়ার থোয়াই মং মার্মার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। এদিকে বিদ্যালয়ের তিন পাশে তামাক চাষ হওয়ায় চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। জানা যায়, একইভাবে লামা উপজেলার কমপক্ষে ৩০টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় ও কোল ঘেঁষে তামাক চাষ হয়। লামা উপজেলা পরিবেশ রক্ষা পরিষদের সভাপতি রুহুল আমিন জানায়, এক সময় ফসল ও সবজি চাষের জন্য সুনাম ছিল এ উপজেলার। কিন্তু মাঠের পর মাঠ এখন চোখে পড়ে শুধু তামাকের ক্ষেত। যত দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে তামাক চাষ। কৃষিবিভাগ তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করলেও তামাক কোম্পানীদের লোভনীয় আশ্বাসে তামাক চাষের দিকেই ঝুঁকে পড়ছেন। এছাড়া তামাক পরিচর্যা করার সময় পাতার বিষাক্ত গ্যাসে তামাক চাষে জড়িত নারী, পুরুষ ও শিশুরা বমি বমি ভাব হয়, মাথা ঘুরানো, শ্বাস কষ্ট সহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে দেখা দেয়। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সানজিদা বিনতে সালাম বলেন, গোটা বিশ্ব যখন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সরব, তখন সবুজ বনায়নের পরিবর্তে তামাক চাষের প্রসার নিয়ে উদ্বিগ্ন অত্র উপজেলার সচেতন মহল। এখনিই পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা না হলে আবাদি জমির উর্বরতা হ্রাস পেয়ে অচিরেই উপজেলায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। লামা পরিবেশ রক্ষা পরিষদের নেতারা আক্ষেপ করে জানায়, অনেক সরকারী জমিতে তামাক চাষ হয়। উৎপাদিত তামাক প্রক্রিয়াজাত করতে সমগ্র উপজেলায় নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৯ সহস্রাধিক তামাক পুড়ানো চুল্লী। এসব চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক বনের কাঠ। ফলে দিন দিন গাছশূন্য হয়ে পড়ছে এখানকার পাহাড়গুলো। বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে পরিবেশ। সরকারী, বে-সরকারী ও স্থানীয় চাষীদের দেয়া তথ্য মতে লামা উপজেলায় বর্তমান মৌসুমে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। তবে কৃষি অধিদপ্তর এ তথ্য মানতে নারাজ। সচেতন কিছু কৃষক বলেন, সরকার যদি কোম্পানীর মতো সহজ শর্তে ঋণসহ ফসল কেনার নিশ্চয়তা দেয় তাহলে তারা তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে অন্যান্য ফসল চাষ করবেন। স্থানীয়রা তামাক চাষকে তাদের ভাগ্য বদলের চাবিকাঠি মনে করে বিধায় তাদের স্কুল কলেজ পড়–য়া শিশুরা স্কুল বাদ দিয়ে তামাক ক্ষেতে কাজ করতে দেখা যায়। তামাক চাষ বিষয়ে কথা হয় ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো হরিণঝিরি ডিপো ম্যানাজার খগেন্দ্র চন্দ্র দাশের সাথে। তিনি বলেন, তামাক একটি অর্থকরী ফসল। যদি পরিবেশগত কিছু ক্ষতি রয়েছে তবে তামাক চাষে মানুষ লাভবান হচ্ছে। লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা: মনিরুজ্জামান মোহাম্মদ বলেন, তামাক শোধনের সময় নির্গত নিকোটিনের কারণে এলাকার লোকজন হাঁপানি, কাশি এবং ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে তিনি অনুরোধ করেন।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: