লালদিয়া চরে উচ্ছেদ আজ, নিঃস্ব ১৪ হাজার মানুষ

প্রকাশিত: ০১ মার্চ ২০২১, ০৪:২৮ পিএম
রবিউল হোসেন রবি, পতেঙ্গা (চট্টগ্রাম) থেকে: ৪৮ বছর আগে চট্টগ্রামের জহুরুল হক বিমানবন্দর ঘাঁটি সম্প্রসারণের জন্য কয়েক হাজার স্থানীয় বাসিন্দাকে সরিয়ে কর্ণফুলী নদীর তীরে লালদিয়ার চরে ৫২ একর জমিতে পুনর্বাসন করে তৎকালীন সরকার। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর ‘জরিপ অনুযায়ী’ চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার লালদিয়ার চরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আদালতের নির্দেশনা দুই মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। বন্দরের হাজার কোটি টাকা মূল্যের ৫২ একর জমিতে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান আজ সোমবার শুরু হচ্ছে। উচ্ছেদের আগে চরবাসি পুনর্বাসনের আকুল আবেদন জানালেও মেলেনি সুরাহা। সোমবার (১ মার্চ) সকাল ৮টা থেকে ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য। এছাড়া ৫২ একর জমির এক হাজারেরও বেশি অবৈধ ছোটবড় পাকা স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিতে প্রস্তুত আছে ২২টি বুলডোজার, স্ক্যাভেটর, ট্রাকসহ দুই শতাধিক শ্রমিক। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরুর আগে এলাকার বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। রোববার (২৮ ফেব্রুয়ারি) উচ্ছেদ অভিযান সফল করতে বন্দর ভবনে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান। স্মরণকালের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করা এ উচ্ছেদের তদারকি করবেন তিনি নিজেই। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন সভায় অভিযানের সার্বিক প্রস্তুতি পর্যালোচনা এবং বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় র‌্যাব-পুলিশ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ, চট্টগ্রাম ওয়াসা. ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ‘কর্ণফুলী তীর দখলমুক্ত করতে আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এটি যথাযথভাবে মানতে হবে। আমরা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করব।’ এদিকে উচ্ছেদ আতঙ্কে ঘর ছাড়তে শুরু করেছে সেখানকার বাসিন্দারা। গতকাল (রোববার) সকাল থেকেই ট্রাক-পিকআপে ও ভ্যানে করে মালামাল নিয়ে এলাকা ছাড়তে দেখা যায় অনেক পরিবারকে। চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে লালদিয়ার চরের বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের দাবি উঠেছে। তবে যারা সেখানে বসবাস করছেন তারা ভাড়া বাড়িতে আছেন। একটি চক্র বন্দরের জমি দখল নিয়ে ঘর তৈরি করে ভাড়া আদায় করেছে। ফলে তাদের পুনর্বাসনের কোন সুযোগ নেই। লালদিয়ার চরের উচ্ছেদ কার্যক্রম প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সফরে এসে নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘ভুয়া কাগজপত্রে লালদিয়ার চরের মাটি বিক্রি করে অনেকেই সম্পদ গড়েছেন। সেখানে পুনর্বাসনের করার মতো কেউ নেই। লালদিয়ার চরে জমি ‘দখলে রেখে’ যারা আর্থিক ‘ফায়দা লুটেছে’ তাদের তালিকা করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর যারা উচ্ছেদের বিপক্ষে ইন্ধন দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।’ এদিকে লালদিয়া চর পুনর্বাসন কমিটির সভাপতি আলমগীর হাসান বলেন, ‘১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমান বন্দর করার সময় আমাদের উচ্ছেদ করে লালদিয়া চরে বসবাস করতে দেয় সরকার। তখন এখানে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে কর্ণফুলীতে বেড়িবাঁধ দিয়ে লালদিয়া চরকে ভাঙন থেকে রক্ষা করা হয়।’ নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর কথা সঠিক নয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, এখানে ভাড়াটিয়ারা থাকে। যৌথ সার্ভে করলে সেটার উত্তর বের হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন, মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, পুলিশ ও সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধি এবং প্রয়োজনে আদালতের প্রতিনিধিসহ থেকে সার্ভে করা হোক।’ এ প্রসঙ্গে বন্দরের ডেপুটি স্টেট ম্যানেজার জিলল্গুর রহমান জানান, গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, আন্দোলনকারীদের বেশিরভাগই লালদিয়ায় থাকেন না। তারা বহিরাগত। গোয়েন্দা সংস্থা এদের তালিকাও তৈরি করেছে। সূত্র জানায়, লালদিয়া চরের ৩০০ পরিবারের এই ১৪ হাজার মানুষকে নিয়ে ‘নোংরা রাজনীতি’ করেছেন স্থানীয় রাজনীতিকরা। ভোটের সময় এলে তাদেরকে স্থায়ী করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আর বাস্তবে দেখা মেলেনা। যার ফলে বন্দরের ভূমিতে 'অবৈধ দখলদার' হিসেবেই রয়ে গেছেন এই ১৪ হাজার মানুষ। ভোট গেলেই তারা চুপ হয়ে যান, আবার উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু হতেই সক্রিয় হয়ে ওঠেন এসব স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকরা। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সাল থেকে লালদিয়ার এলাকায় বসবাস করে আসছেন প্রায় দুই হাজার ৩০০ পরিবারের ১৪ হাজার মানুষ। সেখানে এ, বি ও সি ব্লকে বিভক্ত হয়ে গঠিত হয় লালদিয়ার চর। ২০০৫ সালের ১২ জুলাই লালদিয়ার চরের বি ব্লক থাকা প্রায় পাঁচশ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। ২০১৯ সালেও লালদিয়ার চর এ-ব্লকের কিছু অংশ উচ্ছেদ করার পরও নতুন করে চলতি বছরের আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালতের নির্দেশে এ-ব্লক উচ্ছেদ করার জন্য নোটিশ দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: