করোনায় ধনী আরো ধনী হচ্ছে, গরিব আরো গরিব

প্রকাশিত: ০৯ এপ্রিল ২০২১, ০১:৪৩ এএম
মহামারিকালে এশিয়ায় শতকোটিপতিদের ৭১১ জনের সম্পদ বেড়েছে দেড় ট্রিলিয়ন ডলার (১২৭ লাখ কোটি টাকা),বাংলাদেশে প্রণোদনার সিংহভাগই পেয়েছে বড়রা, নেই ক্রয় সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ করোনার দীর্ঘায়িত প্রভাবে ক্রমেই নিঃস্ব হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। আয় কমে যাচ্ছে। জীবন রক্ষার তাগিদে জীবিকা হারাচ্ছে তারা। দরিদ্র্যসীমার নিচে নেমে দুবেলা খেয়ে-পরে থাকাই কষ্টকর হচ্ছে। অন্যদিকে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে। প্রণোদনার টাকার সিংহভাগ বড়রাই নিয়ে গেছে। এদের কাছেই ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা আটকে থাকার পরও সুবিধা নিতে বা দিতে ভুল করেনি কেউ। বছরের পর বছর নানা ‘ছুতো’য় তারা সময় বাড়িয়েছে। সুদ কমিয়েছে। তারপর প্রণোদনার টাকা নিয়ে দিব্যি আছে। ব্যাংকিং সূত্রগুলো বলেছে, এই অর্থও তারা ঠিকমতো পরিশোধ করবেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। আবার কোনো কোনো ব্যাংকও করোনাকালে সরকারপ্রদত্ত সুবিধাদি নিয়ে নিজেদের ভিত মজবুত করেছে। অথচ স্পনসর পরিচালকদের কেউ কেউ একসময় শেয়ার ছেড়ে দেওয়ার চিন্তাও করেছিলেন। শুধু ব্যাংকের টাকাই নয়, এই অতিমারিতে ব্যবসায় উচ্চ মুনাফা লুটে নিয়েছে ধনিক শ্রেণি। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে জোর লবিংয়ের সক্ষমতাও তাদের রয়েছে। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কিংবা সাধারণের বিষয়ে তাদের সহমর্মিতা না দেখালেও কিছু আসে যায় না। অতিমারিকালে জরুরি পণ্যসেবার ব্যবসায়ও বড়রা উচ্চ মুনাফার লোভ সামলাতে পারেনি। হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিংবা ভাইরাসের টিকা, হাসপাতাল সেবা কিংবা জরুরি ওষুধপত্র—সব ক্ষেত্রেই তারা লাভবান হয়েছে। পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়ানোই শুধু নয়, পণ্য প্রাপ্তির সহজলভ্যতা রুখে কৃত্রিম সংকট তৈরিও করা হয়েছিল। আতঙ্কগ্রস্ত অসহায় সাধারণ মানুষের করার কিছুই ছিল না। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে একই চিত্র। করোনার প্রভাবে সারা বিশ্বেই বৈষম্য বাড়ছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় মানুষের আয় কমে গেছে ব্যাপক হারে। একদিকে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় উত্পাদনব্যবস্থায়ও এর প্রভাব পড়েছে। অর্থনীতির চক্রাকার প্রবাহের আঘাতে প্রকৃতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষ। বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হলেই দরিদ্র দেশগুলো তা থেকে লাভবান হবে এমন আশা করা যাচ্ছে না। কারণ দেশে দেশে বাড়ছে ঋণের বোঝা। শুধু দরিদ্র দেশ নয়, এই মহামারির সবচেয়ে বড় ভার বইতে হচ্ছে দরিদ্র মানুষকে। গত বছরের অক্টোবর মাসে বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে ১১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। এ সংখ্যা ১৫ কোটি হতে পারে বলে তখন ধারণা করা হয়েছিল। ধনী ব্যক্তিরা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারলেও বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের সাধারণ জনগোষ্ঠী। আয় কমে যাওয়ায় নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়ছে স্বল্প আয়ের মানুষ। করোনার দ্বিতীয় এই ধাক্কায় লকডাউন শুরু হয়ে যাচ্ছে। সরাসরি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প, অসংগঠিত খাতে। কিন্তু বড় পুঁজিপতিরা নতুন করে লাভবান হবে। যেভাবে গত এক বছরে হয়েছিল। সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে যখন বিপর্যয়কর অবস্থা, তখন বিশ্বের ১ হাজার শীর্ষ ধনী এই মহামারি চলাকালেও মাত্র ৯ মাসে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছেন। তবে করোনার অর্থনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বিশ্বের কয়েক শ কোটি দরিদ্র মানুষের এক দশকের বেশি সময় লেগে যেতে পারে। ‘অসমতা ভাইরাস’ নিয়ে এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ একযোগে বিশ্বের প্রায় সব দেশে ধনী-গরিবের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য বাড়িয়ে তুলেছে। এই প্রথম একই সময়ে প্রায় প্রতিটি দেশে অসমতা বৃদ্ধির ঘটনা ঘটল। করোনা মহামারি চলার মধ্যেই গত বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এশিয়ায় ৭১১ জন শত কোটিপতির সম্পদ বেড়েছে দেড় ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১২৭ লাখ কোটি টাকা। কোভিড-১৯-এর প্রভাবে দরিদ্র হয়ে গেছে এমন ১৫ কোটি ৭০ লাখ মানুষের প্রত্যেককে এই অর্থ দিয়ে ৯ হাজার ডলারের একেকটি চেক দেওয়া সম্ভব। করোনার প্রভাবে বাংলাদেশেও ধনীরা ধনী হয়েছে। গরীবেরা আরো গরিব হয়েছে। অন্যান্য দেশে ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবাইকে প্রণোদনা সুবিধার আওতায় আনা হলেও বাংলাদেশে তা হয়নি। ক্রেতার ক্রয়সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শুধু উত্পাদকদের সুবিধা দিলে তো হবে না, ক্রেতার পকেটেও টাকা থাকতে হবে। তাহলেই সে পণ্য কিনবে। উত্পাদকের পণ্য উত্পাদন করলেই হবে না, ক্রেতারা না কিনলে উত্পাদক বড় ঝুঁকিতে পড়ে যায়। সে বিষয়টি আমাদের এখানে গুরুত্ব পায়নি। ফলে বৈষম্য আরো প্রকট হয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার কারণে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, মানুষের আয় কমেছে। ফলে দারিদ্র্যের হারও বেড়ে গেছে। সিপিডির মতে, করোনার কারণে গিনি সহগে ভোগের বৈষম্য বেড়ে দশমিক ৩৫ পয়েন্ট হয়েছে। ২০১৬ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে এটি ছিল দশমিক ৩২ পয়েন্ট। একইভাবে আয়ের বৈষম্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৫২ পয়েন্ট। ২০১৬ সালের হিসাবে এটি ছিল দশমিক ৪৮ পয়েন্ট। সাধারণত গিনি সহগে আয়ের বৈষম্য দশমিক ৫০ পয়েন্ট পেরোলেই উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হিসেবে ধরা হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের করা এক জরিপে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৪২ শতাংশ। দেশব্যাপী খানা পর্যায়ের জরিপ করে গত জানুয়ারির শেষ দিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমনটি দাবি করা হয়েছে। জরিপের আরেকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, ২০২০ সালে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে রেমিট্যান্স বা প্রবাসীয় আয়ের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হলেও ব্যক্তি পর্যায়ে তা বরং কমে গেছে। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, করোনার প্রভাবে দারিদ্র্যের কারণে মানুষ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছেন, ঋণ নিয়েছেন, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছেন। বৈষম্য বৃদ্ধির বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, শুধু আয়বৈষম্যই নয়, গবেষণায় দেখা গেছে করোনার প্রভাবে দেশে স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতেও বৈষম্য বেড়েছে। তাছাড়া নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়তেও দেখা গেছে। বৈষম্য কমাতে সরকরি উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এতে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বৈষম্য হ্রাসে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত করে সাজানোর পাশাপাশি প্রণোদনাগুলো শ্রমিকবান্ধব করার তাগিদ দেন তিনি। সূত্র: ইত্তেফাক

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: