রূপগঞ্জের শতবর্ষী নান্দনিক জমিদারবাড়ি মুড়াপাড়া

প্রকাশিত: ০৬ মে ২০২১, ০৮:৪৫ পিএম
সহিদূল করিম বিপ্লব, রুপগঞ্জ থেকে: দুপুর তখন ২ টা কি আড়াইটা। বিশাল আকৃতির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মনটা প্রফুল্ল হয়ে গেল। রাজাবাদশাদের রাজবাড়ি এতো সুন্দর নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। যেই রাজবাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করলাম গা-টা কেমন যেন ছমছম করে উঠলো। চারদিকে ভয়ংকর পরিবেশ। স্যাঁতস্যাতে ভগ্নদশা ভবন আর নীরব-নিস্তব্ধতা দেখে কাতর হয়ে গেলাম। সহসাই এক তরুণের সাক্ষাৎ পেয়ে সাহসটা বেড়ে গেল। পাঠক আপনিও একবারের জন্য ঘুরে আসতে পারেন রাজধানী ঢাকার কাছের এ রাজবাড়ি। বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও শতবর্ষী জমিদার বাড়ি এটি। বিভিন্ন সময় এ জমিদার বাড়িটি কয়েকজন জমিদার কর্তৃক সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। মুড়াপাড়া রাজবাড়িটি ৬২বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে। গোড়পত্তন করেন বাবু রামরতন ব্যাণার্জী। এরপর তার কয়েকজন বংশধর কর্তৃক প্রাসাদটি সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে জমিদার প্রতাপচন্দ্র ব্যাণার্জী এই ভবনের পিছনের অংশ সম্প্রসারণ করেন ও পরিবার নিয়ে এখানেই বসবাস শুরু করেন। তার পুত্র বিজয় চন্দ্র ব্যাণার্জী ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাসাদের সামনের অংশে একটি ভবন নির্মাণ ও ২ টি পুকুর খনন করেন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে তার দুই পুত্র জগদীশ চন্দ্র ব্যাণার্জী ও আশুতোষ চন্দ্র ব্যাণার্জী কর্তৃক প্রাসাদের দোতালার কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৪৭ খিষ্ট্রাব্দে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর জগদীশ চন্দ্র তার পরিবার নিয়ে কলকাতা গমন করেন। এরপর থেকে বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাড়িটি দখল নেয় এবং এখানে হাসপাতাল ও কিশোরী সংশোধন কেন্দ্রের কার্যক্রম পরিচালনা করা হত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাড়িটির দায়িত্ব গ্রহণ করে সেটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। স্থানীয় কয়েকজন সত্তোর্ধ মুরুব্বীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময়ের ঘোড়ার পায়ের ঠক ঠক শব্দ, হাতীর পিঠে চড়ে জমিদারদের ভ্রমন, পাইক পেয়াদার পদচারনায় মূখরিত ছিল যে বাড়িটি আজ তা প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মৃতি শুধু। কালের গহ্বরে প্রাচীন ঐতিহ্যে ঢাকা পড়লেও এর নিদর্শন চিরকাল অম্লান। রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ার জমিদার বাড়িটি তেমনই একটি স্মৃতিচিহ্ন। এ বাড়িটিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে রূপগঞ্জের ইতিহাস, কৃষ্টি, সভ্যতা ও আজকের এই কোলাহলপূর্ণ জনবসতি। শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে মহাকালের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এ জমিদার বাড়ি। পাখি ডাকা ছায়া সু-নিবিড় পরিবেশে গড়ে ওঠা মনোমুগ্ধকর এ জমিদার বাড়িটি দেখতে যে কারো মান চাইবে। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার মুড়াপাড়া এলাকায় ৬২ বিঘা জমির ওপর এই প্রকান্ড- জমিদার বাড়ি অবস্থিত। জমিদার বাবু রামরতন ব্যানার্জী তৎকালীন মুড়াপাড়া জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন করেন। রামরতন ব্যানার্জীর পুত্র পিতাম্বর ব্যানার্জী এবং তৎপুত্র প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জী শাহজাদপুরের জমিদারি ক্রয় করে জমিদারি শুরু করেন। কথিত আছে, জমিদারি ক্রয় সূত্রে প্রতাপ ব্যানার্জীর সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। ১৮৮৯ সালে প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জীর পৈতৃক এজমালি পুরনো বাড়ি ত্যাগ করে আলোচ্য এ প্রাসাদের পেছনের অংশ নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জীর পুত্র বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জী ১৮৯৯ সালে প্রাসাদের সম্মুখ অংশের একতলা ভবন নির্মাণ ও সেখানে ২টি পুকুর খনন করার পর জটিল রোগে ভুগে মারা যান। তিনি ছিলেন এ অ লের প্রথম গ্র্যাজুয়েট। বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জীর দুই সুযোগ্য পুত্র জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী ও আশুতোষ চন্দ্র ব্যানার্জী ১৯০৯ সালে প্রাসাদটির দোতলার কাজ সম্পন্ন করেন। এ অ লে জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জীর নাম সমধিক প্রসিদ্ধ। কারণ তিনি দু’বার দিলি¬র কাউন্সিল অব স্টেটের পূর্ববঙ্গ থেকে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। জমিদার জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী প্রজা সাধারণের কল্যাণসাধনের জন্য স্থাপন করেছেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও পুকুর। জমিদারদের আয়ের উৎস বলতে প্রজার ওপর ধার্যকৃত খাজনা আদায়, বন জঙ্গল এবং সুপারির বাগান। একটা সময় প্রজাদের ওপর শুরু হয় অত্যাচার-নিপিড়ন,ক্ষমতার অপব্যবহার। সুন্দরী মেয়ে, ঘরের বধূ, এদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়লে রেহাই পেতো না। ধীরে ধীরে অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে। আর আজো সেসব রসময় কাহিনী অত্যাচার নির্যাতন প্রভাবের গল্প গ্রামা লে কল্পকাহিনীর মতো ছড়িয়ে আছে। জমিদারি প্রথার শেষ দিকে নানাভাবে বিদ্রোহের পটভুমি তারই অংশ। কথিত আছে, জমিদার বাড়িতে দুটি গোপন সুরঙ্গ রয়েছে। একটি সুরঙ্গ থেকে প্রতি অমাবস্যাতে প্রকান্ড সাপ বের হয়ে সামনের পুকুরে স্নান করে। তবে এর সঠিক ভিক্তি পাওয়া যায়নি। আরকেটি সুরঙ্গের তালা আজ অবধি কেউ খুলতেই পারেনি। তবে এ প্রতিবেদক দেখার চেষ্টা করে কোন প্রমাণ পাননি। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন জমিদার জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী সপরিবারে কলকাতায় চলে যান। ফলে জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জীর প্রতাপশালী সেই রাজবাড়িটি শুণ্য হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি সরকারের দখলে চলে আসে। তৎকালীন সরকার এখানে একটি হাসপাতাল স্থাপন করে। কিছুকাল এটি কিশোর সংশোধনী কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। পরে ১৯৬৬ সালে এখানে হাইস্কুল ও কলেজ স্থাপিত হয়। বর্তমানে এই জমিদার বাড়িটি মুড়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়িটি ঘুরে জানা গেছে, বিশাল দোতলা এ জমিদার বাড়িটিতে রয়েছে মোট ৯৫টি কক্ষ। নাচঘর, আস্তাবল, উপাসনালয়, ভান্ডার, কাচারি ঘরসহ সবই। বিশালাকৃতির প্রধান ফটক পেরিয়ে ঢুকতে হয় ভেতরে। অন্দর মহলে রয়েছে আরও ২টি ফটক। সর্বশেষ ফটক পেরিয়ে মেয়েদের স্নানের জন্য ছিল শানবাঁধা পুকুর। পুকুরের চারধার উঁচু দেয়ালে ঘেরা। এখানে প্রবেশ বাইরের লোকদের জন্য ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সচরাচর কোন পুরুষ যেত না সেখানে। বাড়ির সামনে রয়েছে আরও একটি বিশাল পুকুর। পুকুরটির চারদিক নকশি কাটা ঢালাই লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা। আর চারদিকে চারটি শানবাঁধানো ঘাট। মূলত এ পুকুরটি তৈরি করা হয়েছিলো বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধন এবং পুরুষ মেহমানদের গোসলের জন্যই। পুকুরসংলগ্ন মন্দির। মন্দিরে বড় দু’টি চূড়া রয়েছে। তা প্রায় ৩০ ফুট উঁচু। এর প্রবেশ দ্বারগুলো খিলান দিয়ে নির্মিত। মন্দিরের মূল কক্ষ বেশ ছোট এবং অন্ধকার। মন্দিরের পাশ ঘেঁষে রয়েছে ছায়াঘেরা শান্ত-শ্যামল আম্রকানন। গাছগুলো বেশ পুরনো। একই মাপের ঝাঁকড়ানো গাছ। ডাল-পালা ছড়ানো, অনেকটা ছাতার মতো। অসংখ্য গাছ। প্রায় প্রতিটি আম গাছের গোড়া পাকা করা। এছাড়া জমিদার বাড়ির প্রবেশমুখেই রয়েছে সারি সারি ঝাউ গাছ। কোন ভ্রমনপিপাসু ব্যাক্তিরা এ জমিদারবাড়িটি দেখতে চাইলে ঢাকা থেকে আসতে সময় লাগে মাত্র ৩০/৪০ মিনিট। বাসে কিংবা সিএনজি প্রাইভেট কারে করে আসতে পারেন এখানে। রাজধানী ঢাকার সায়েদাবাদ, গুলিস্থান অথবা যাত্রাবাড়ি থেকে যে কোন পরিবহনে রূপগঞ্জের রূপসী বাসস্ট্যান্ড কিংবা ভুলতা পর্যন্ত। সেখান থেকে সিএনজি অথবা রিকশাযোগে পিচঢালা রাস্তায় সহজেই আসা যায় এ জমিদার বাড়িতে। রাজধানীর ডেমরাঘাট হয়ে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে মাঝিনা ঘাট থেকে নৌকায় শীতলক্ষ্যা নদী পার হলেই রূপগঞ্জের জমিদার বাড়ি।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: