৫০ বছরের পুরোনো নথি, জানা গেল আওয়ামী লীগ নেতার বাবা ছিল রাজাকার !

প্রকাশিত: ১১ মে ২০২১, ০৩:৪৪ পিএম
রবিউল হোসেন রবি, চট্টগ্রাম থেকে: সম্প্রতি সারিকাইতের একজন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার বাড়ির পুরোনো কাগজপত্রের সাথে পাওয়া ৫০ বছর আগের একটি নথি ঘেটে দেখা যায় ‘টাউট’ ও ‘গুন্ডা’ হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন সন্দ্বীপ উপজেলার সারিকাইত ইউনিয়নের আব্দুল মতিন৷ যুদ্ধের পর পরই সারিকাইত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের করা টাউট গুন্ডাদের তালিকার প্রথম নামটিই তার। বিষয়টি নিয়ে সোরগোল পরে গেছে এলাকায়। তবে কোন এক অদৃশ্য চাপে হোক বা ভয়ে হোক বিষয়টি নিয়ে খুব একটা কথা বলতে চাইছেননা সংশ্লিষ্টরা। কি আছে সেই নথিতে: হাতে লেখা নথিটিতে দেখা যায় ‘২৫ মার্চের পরে সময়ে সামাজিক টাউট, দালাল ও গুন্ডা ইত্যাদির সবিস্তার তালিকা’ শিরোনামে একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি সারিকাইত ইউনিয়ন আ.লীগের তৎকালীন সভাপতি এস এম নুরুল হুদা সাক্ষরিত ওই নথিতে ১৯৭১ সালের ১৫ শে মার্চ এবং তার পরবর্তী সময়ে ৯ ও ১০ নম্বর ওয়ার্ডে যারা দালাল এবং গুন্ডা ছিল তাদের কার্যকলাপের বিস্তারিতসহ তুলে ধরা হয়েছে। নথির তথ্যানুযায়ী, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের তালিকায় থাকা প্রথম দুই ব্যক্তি হলেন— চৌকাতলীর হাবিব উল্ল্যার পুত্র আবদুল মতিন এবং তার ভাই আবদুল জলিল। তৎকালীন সময়ে দুই ভাই আবদুল মতিন এবং আবদুল জলিল রচিয়া খাতুন নামে এক নারীর সাথে অবৈধ মেলামেশা করতেন। যার ফলে গর্ভবতীও হয়েছিলেন ওই নারী। এছাড়া, নিরীহ জনসাধারণ এবং আ.লীগ কর্মীদের ওপর তারা চালাতেন অমানবিক নির্যাতন। শুধু কি তাই? বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে তাদের হয়রানি করার সুযোগটিও ছাড়েনি এই দুই ভাই।— এমনটাই উল্লেখ করা আছে ওই নথিতে। ওই নথির তালিকায় ১ নম্বরে থাকা মৃত আবদুল জলিলের পুত্র বর্তমান ইউনিয়ন আ.লীগের সেক্রেটারি আকতার হোসেন শিবলী। অন্যদিকে ২ নম্বরে থাকা আবদুল জলিল হলেন শিবলীর চাচা। কি বলছে স্থানীয় আওয়ামী সংশ্লিষ্টরা: অনুপ্রবেশকারী ঠেকাতে বর্তমানে বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে। তবুও কিভাবে একাত্তরের দালাল পুত্র আকতার হোসেন শিবলী আ.লীগের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদবি পেলো, তা নিয়ে জনমনে উঠেছে নানা প্রশ্ন। এনিয়ে স্থানীয়দের মনে এবং প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাদের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। যে ঘর থেকে এই নথিটি উদ্ধার হয়েছে সেই ঘরের মালিক মো. পিন্টু বিডি২৪লাইভকে বলেন, ‘বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটির নেতৃবৃন্দের আশকারা পেয়ে এবং তাদের আঁতাতেই দালাল পুত্র এবং আওয়ামী বিরোধী শিবিরের লোক কমিটিতে স্থান পেয়েছে। যার ফলে জননেত্রী শেখ হাসিনার এবং দেশের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধু তাই নয়, এসব অনুপ্রবেশকারীদের জন্য প্রকৃত আওয়ামীলীগাররা কোনঠাসা হয়ে আছে।’ সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহজাহান বিএ’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘তখন কাউন্সিল অধিবেশনের নির্বাচন হয়েছিল। তখন সে কমিটিতে স্থান পেয়েছে। আমাদের নেত্রী অনেক চেষ্টা করলেও সারা বাংলাদেশে এখন অনুপ্রবেশকারী ঢুকে গেছে। পুরো দেশ কিভাবে চলছে তা আপনারা নিজেরাও উপলব্ধি করছেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নথি সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেলা আছে, কেন্দ্র আছে। এগুলো জাতীয় পর্যায়ে হবে।’ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এস এম নুরুল হুদা সারিকাইত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহজাহান বিএ। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সন্দ্বীপে বিএলএফের কমান্ডার ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন এবিষয়ে বিডি২৪লাইভকে বলেন, ‘এস এম নুরুল হুদা সেসময় সারিকাইত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিল। আর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিনতো নামকরা মুক্তিযোদ্ধা। ১ নম্বর সেক্টরে বীর বিক্রম রফিকুল ইসলামের সাথে যুদ্ধ করেছেন তিনি। তবে নথির ব্যাপারে আমি কিছু জানিনা। আশা করি দায়িত্বশীল নেতারা এই বিষয়ে খোঁজ খবর নিবেন। আমিও খোঁজ নিয়ে দেখবো।’ নথির বিষয়ে কিছুই জানেন না জানিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনউদ্দিন মিশন বলেন, ‘আমরা তার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জানিনা। যখন সে কমিটিতে আসে তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তখন সভাপতি ছিলেন শাহজাহান বিএ এবং সেক্রেটারি ছিলেন মোহাম্মদ আলী খসরু। আমরা বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নিব।’ তবে আকতার হোসেন শিবলির পিতা আব্দুল মতিনের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বিতর্কিত ভূমিকার কথা নিশ্চিত করেছেন সন্দ্বীপ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার মাযহারুল ইসলাম। তিনি বিডি২৪লাইভকে বলেন, 'ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সে সময়ের নথির বিষয়টি জানিনা। কিন্তু আব্দুল মতিন শান্তি বাহিনীর লাঠিয়াল ছিল এটাতো সবাই জানে।' মুক্তিযোদ্ধা মাজহারুল ইসলাম বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধা ইয়াছিন নামে যার ঘর থেকে নথিটি পাওয়া গেছে বলছেন তারা তিন ভাই ছিল খাঁটি আওয়ামী লীগ। তবে নথি সম্পর্কে যারা বলতে পারবে তারা তো কেউ বেঁচে নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ছাত্র ছিলাম এবং ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম। তখন আমরা আবদুল মতিনদের থেকে ভয়ে দূরে দূরে থাকতাম।’ সেই সময়ে আবদুল মতিন এবং জলিলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ নথিতে উল্লেখ আছে— এ সম্পর্কে জানতে চাইলে মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘এসব কাজে তারা পারদর্শী ছিল। আবদুল মতিন একজন চরিত্রহীন লোক ছিল। আর বর্তমান যে সেক্রেটারি শিবলী, তার সাথে প্রভাবশালী নেতাদের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে অনেকেই এসব নিয়ে কথা বলতে চায় না। স্বাধীনতা বিরোধী একজনের ছেলে কিভাবে আ.লীগের কমিটিতে নেতৃত্বে আসে সেটাতো অনেকেরই প্রশ্ন। আজকালতো লবিং চালিয়ে অনেক কিছুই সম্ভব।’ কি বলছেন তালিকায় নাম থাকা ব্যাক্তির সন্তান: এসব বিষয়ে কথা বলতে সারিকাইত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন শিবলীকে কল করা হলে তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী এবং তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামীলীগার দাবি করে বলেন, ‘আমি ছোট থেকেই আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য ছিলাম এবং এখনও আছি। আমার বাবা সম্পর্কে অভিযোগের বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। আমি যতটুকু দেখে আসছি আমার বাবারা আ.লীগের রাজনীতির সাথেই জড়িত ছিল এবং তারা নৌকার পক্ষেই কাজ করেছেন।’ তবে তিনি ছোট বেলা থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে আসছেন দাবি করলেও মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সারিকাইত ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি এস এম নুরুল হুদা এবং মুক্তিযোদ্ধা ইয়াছিনকে চেনেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘না আমি এদের চিনি না। নথি সম্পর্কেও কিছু জানিনা। যেকোনো স্বার্থান্বেষী মহল আমার বাবার বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার চালাতে পারে বা এগুলো করতে পারে।’

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: