যেন থেমে না যায় বাংলাদেশ!

রাজন ভট্টাচার্য: রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, ভূমিহীনদের ঘর দেয়া সহ সামাজিক নানা কর্মসূচীর কারণে বাংলাদেশ গোটা পৃথিবীর কাছে মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে নজির স্থাপন করেছে। অর্থনীতি সহ বৈশ্বিক নানা মানদন্ডে অন্যান্য সমকক্ষ দেশের চেয়ে বাংলাদেশ যখন অনেক এগিয়ে ঠিক তখন নতুন করেমহাচ্যালেঞ্জের মুখে শেখ হাসিনার সরকার তথা গোটা জাতি। তবে এটা যে শুধু বাংলাদেশের জন্য বিপদ তা নয়, গোটা বিশ্বই আজ কোভিডমহামারি মোকাবেলা করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এইপরিস্থিতি মোকাবেলা সবচেয়ে কঠিন।
ভারতের ডেল্টা ভেরিয়েন্ট দেশে এখন গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়েছে। প্রায় ৮০ভাগ মানুষ নতুন এই ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত। যদিও অনেক আগে থেকেই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সরকারকে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু জীবন ও অর্থনীতি সচল রাখার প্রয়োজনে হয়ত সরকার সব পরামর্শ মেনে চলতে পারেনি। কিছু ভুল পদক্ষেপ ছিল, এটাও সত্যি। আগে থেকে আরো বেশি যদি সতর্ক হওয়া গেলে হয়ত ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কার প্রয়োজন হত না।
ডেল্টা ভেরিয়েন্ট প্রথমে দেশের সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে ছড়িয়েছে। আস্তে আস্তে তা সারাদেশে বিস্তার ঘটায়। এখন রাজধানী ঢাকায় মৃত্যু ও সংক্রমণ কমলেও বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় রোগীর চাপ বেশি। তাছাড়া আগে পুরুষের মৃত্যু সংখ্যা বেশি হলে এখন কিন্তু নারী সহ সব বয়সের মানুষ মারা যাচ্ছে। নারী মৃত্যু হার দাঁড়িয়েছে ৪০ভাগ। তার মানে হলো অবহেলায় সংক্রমণ বেড়েছে। ক্ষতিকর ডেল্টা ভাইরাসও আগ্রাসী হয়ে বাড়াচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।
দেশের জেলা, উপজেলায় করোনার উন্নত চিকিৎসা এখনও প্রসারিত করা যায়নি। দেড় বছরেও স্বাস্থ্য খাতের বড় ব্যর্থতা এটি। স্বাস্থ্য বিভাগকে বিতর্ক আর সমালোচনার উর্ধে নেয়া সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে খোদ সরকার দলের এমপিরাই সন্তুষ্ট নন। সম্প্রতি সংসদ অধিবেশনে সিনিয়র রাজনীতিকরা স্বাস্থ্য বিভাগের তীব্র সমালোচনা করে মন্ত্রীর পদত্যাগ পর্যন্ত দাবি করতে দেখা গেছে।
বিভাগীয় শহরগুলোতে চিকিৎসা ব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি দেখা গেলেও জেলা হাসপাতাল গুলোতে আইসিআই বা প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ কিন্তু একেবারেই কম। বিশ্বের অন্যান্য দেশে করোনা বারবার চোখ রাঙাতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও তৃতীয় ওয়েব পর্যন্ত চলছে। রাতদিন লাশ অন্তোষ্টিক্রিয়ার কারণে দিল্লীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির খবরও গোটা বিশ্বে আলোচিত। অতি মৃত্যুর কারণে অনেক দেশে দেয়া হয়েছে গণকবর।
আমাদের দেশে প্রথম ধাক্কার পর একেবারে হাত গুটিয়ে বসে থাকা ঠিক হয়নি। আবারো সংক্রমণ বাড়তে পারে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের চিত্র দেখে ব্যাপকভাবেপরবর্তী ওয়েভ মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়ার প্রয়োজন ছিল। করোনা চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো আইসিইউ সেবা ও অক্সিজেন। একারণে ঢাকার বাইরের বেশি রোগী মারা যাওয়ার কথা বলছেন চিকিৎসকরা।
মহাখালী বিশেষায়িত কোভিড হাসপাতালের পরিচালক এ কে এম নাসির উদ্দিনের কথা ধরে যদি বলি, আক্রান্তদের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ ভাগ রোগিকে আইসিইউ সেবা দিতে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সেবা না পেয়ে জেলা বা উপজেলা শহর থেকে যেসব রোগীকে ঢাকায় আনা হচ্ছে তাদের একটা বড় অংশের মৃত্যু হচ্ছে।এক হাজার সয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালে আছে ২১২ আইসিইউ। সব মিলিয়ে আইসিইউ মাপের সেবা আছে ৫০০ বেডে। বাকি ৫০০ বেড চলে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে।
কথা হলো সরকারী হাসপাতাল গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আইসিইউ এই হাসপাতালে। বর্তমানে রোগীর সংখ্যার তুলনায় যা খুবই অপ্রতুল। যদি জেলা শহর গুলোতে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো, তাহলে এই হাসপাতালটি সহ রাজধানীর অন্যান্য সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল মিলিয়ে ঢাকার রোগীদের চিকিৎসার চাপ অনেকটাই হয়ত সামাল দেয়া যেত।
প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। এমন বাস্তবতায় ঢাকার বাইরে থেকে নিয়ে আসা রোগীদের ভর্তির জন্য একের পর এক হাসপাতাল ঘুরতে হচ্ছে। আইসিইউ দূরের কথা, অক্সিজেনের জন্য সাধারণ বেড কোন কোন সময় মিলছে না। কিন্তু জটিল এসব রোগীদের বড় অংশই অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল নয়। তাদের অসহায় হয়ে হাসপাতালের গেটে ধন্না দেয়া ছাড়া কিছু করার নেই।
চিকিৎসার জন্য স্বজনদের বিলাপ, আর রোগীর মৃত্যু যন্ত্রণার দৃশ্য যখন গণমাধ্যমে প্রচার হয় তখন বিশ্বে দেশের জন্য ভালো বার্তা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা হলো রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে চিকিৎসা পাওয়া একজন ব্যক্তির অধিকার। রাষ্ট্র সেই অধিকার পূরণে বাধ্য। তবে কেন রোগিকে এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে হবে? এর জবাব হয়ত সরকারের নীতি নির্ধারকরাই ভালো দিতে পারবেন।
বেসরকারী হাসপাতালে সহজেই চিকিৎসার জন্য এসব পরিবারগুলো পা বাড়ানোর সাহস করে না। কারণ সেখানে মোটা দাগের খরচ। রাত পোহালেই লাখ লাখ টাকা দরকার। সময়ের প্রয়োজনে এখন করোনায় আক্রান্ত রোগীদের বেসরকারী হাসপাতালে সরকারী ব্যয়ে চিকিৎসা করানোর ঘোষণা দেয়া জরুরী। সরকার যেভাবেই হোক এসব হাসাপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সরকারী নিয়মে ব্যয় নির্বাহের চুক্তি করতে পারে। তাহলে তো সাধারণ রোগীদের সঠিক চিকিৎসার জায়গাটি আরেকটু বেশি নিশ্চিত করা সম্ভব। এই প্রক্রিয়াটি সারাদেশের বড় বড় বেসরকারী সকল হাসপাতালের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে।
গোটা পৃথিবীজুড়েই বিপর্যয় কালীন সময়ে একটি জাতির জন্য সবাই এক হয়ে কাজ করার নজির আছে। তাহলে আমরা কেন নয়। আশাকরি বেসরকারী হাসপাতাল গুলোকে সরকারী নিয়মে কোভিড চিকিৎসা সেবা দিতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দিলে তারা দ্বিমত করবে না। অর্থাৎ সরকারী হাসপাতালে একজন রোগীর চিকিৎসার জন্য সরকারের যে পরিমাণ ব্যয় হয় বেসরকারী হাসাপাতাল গুলোতে সরকার সম পরিমাণ ব্যয় নির্বাহ করবে। বেসরকারী হাসপাতাল গুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত এ ঘোষণা দেয়া উচিত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জেলা হাসপাতাল গুলোতে কোভিড চিকিৎসার পরিধি বাড়ানোর নির্দেশনা আমরা দেখিছি। তা দ্রুত সময়ে বাস্তবায়ন করার বিকল্প নেই। অক্সিজেন সরবরাহ ও আইসিইউ সয্যা বাড়ানো গেলে মৃত্যু সংখ্যা কমে আসবে। সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা ও প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ কমিটির কারফিউ জারির পরামর্শ সরকারকে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। টিকা কার্যক্রম চলমান থাকলে মনে হয় এই দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরো অন্তত এক মাসের বেশি সময় লাগতে পারে। এরমধ্যে কোভিড সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ার আশঙ্কা তো রয়েছেই। অন্যান্য দেশগুলোতে কিন্তু সরকার কঠোর হয়ে এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কঠোর লকডাউন, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা ও টিকা কার্যক্রম সমানতালে চালিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে রোগি বাড়ছে। কিন্তু কেউ যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়। লাশ যেন রাস্তায় পড়ে না থাকে। একটি সিটের জন্য হাসপাতালে হাসপাতালে গিয়ে রোগীর স্বজনদের আহাজারি করতে না হয়। শেষ কথা হলো কোভিড পরিস্থিতি মোকাবেলায় সুষ্ঠু পরিকল্পনা আর কিছু কিছু ভুল ত্রুটির জন্য এগিয়ে চলার বাংলাদেশ যেন থেমে না যায়।
লেখক : সাংবাদিক
(খোলা কলামে প্রকাশিত সব লেখা একান্তই লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে পত্রিকার কোন সম্পর্ক নেই)
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]

পাঠকের মন্তব্য: