সাংবাদিক হয়রানির শেষ কোথায়?

প্রকাশিত: ১৩ জুলাই ২০২১, ১০:০১ পিএম
রেজাউল করিম: পুরনো কথা বাদ। নতুন করে বলি। রবিবার সকাল বেলা কোপা আমেরিকা ফুটবল টুর্ণামেন্টের ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফাইনলাল ম্যাচটি দেখতে পুরো বিশ্ব টিভির সামনে বসে আছে। সাংবাদিকরাও এর বাইরে নয়। এমন সময় গণমাধ্যমে প্রচার হলো একজন সাংবাদিক হয়রানির সংবাদ। সংবাদে ম্যাচটির আনন্দ সাংবাদিক মহলে বিষাদে পরিনত হল। হ্যা। তানভির হাসান তানুর গ্রেপ্তারের বিষয়টির কথা বলছি। শনিবার (১০ জুলাই) রাত সাড়ে আটটার দিকে ঠাকুরগাঁওয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার খোঁজখবর জানতে থানায় গেলে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, দৈনিক ইত্তেফাক ও জাগোনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। এরআগে তিনি বিডি২৪লাইভ ডটকমের মাধ্যমে সাংবাদিকতার কর্মজীবন শুরু করেন। এছাড়াও তিনি ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাবের দফতর সম্পাদক ও ঠাকুরগাঁও অনলাইন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার অপরাধ , তিনি গত ৫ ও ৬ জুলাই ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের খাবারের অনিয়ম নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ জুলাই হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. নাদিরুল আজিজ বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫(১)(ক) ২৫(১)(খ) ২৯(১)/৩১(১)/৩৫(১) ধারায় সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। তিনটি গণমাধ্যমের সক্রিয় সাংবাদিক এবং সাংবাদিক নেতা। গ্রহণ যোগ্য সংবাদ উপস্থাপন। এমন সংবাদ কর্মীর পায়ের তলায় ধুলো না থাকলে একজন সাধারণ সংবাদ কর্মীর অবস্থা কতোটা নাজুক হতে পারে ? এমন খবরে অল্প সময়ে সাংবাদিক মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সাংবাদিক তানুকে ঠাকুরগাঁও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) ডালিম কুমার রায় সাংবাদিক তানভীর তানুর ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। অপরদিকে তার আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে তার জামিন আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকায় আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন। একজন সাংবাদিকের জামিন পাওয়াটাই কি হয়রানির শেষ? নাকি তাকে নিরাপত্তা দিতে হবে? অন্যায় বা দুর্নীতির সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে? সাংবাদিকতা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। স্তম্ভটি কতোটা মজবুত অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রকে তা ভাবতে হবে। জাতির বিবেক বলে প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত হচ্ছেন। একসময় রাজধানী বা বিভাগীয় শহরের সাংবাদিকদের নির্যাতন সিমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে এটা মফস্বলে ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তাহীনতা ও আশংঙ্কায় থাকে মফস্বলের সাংবাদিকরা। স্থানীয় প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা বা সদস্য, সবার বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এমন কি সাংবাদিক হত্যা আর নির্যাতন-নিপীড়নের বিচারও সঠিক সময়ে হচ্ছে না। হত্যা ও নির্যাতনের অগুনতি মামলা বছরের পর বছর ঝুলে আছে। বিচারের কোনো অগ্রগতি নেই। বিচার না করায় দেশে এখন সাংবাদিক নির্যাতন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ভয়ভীতি, হুমকি-ধমকি, মামলা-মোকদ্দমা, মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনে ও জখম থেকে শুরু করে গুম কিংবা খুন নির্যাতনের এমন কোনো ধরন নেই যার শিকার হচ্ছেন না সাংবাদিকরা। অথচ সাংবাদিকরাই দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যাদের লেখনীর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা জনসম্মুখে ফুটে ওঠে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনি হত্যা মামলার দীর্ঘ ৯ বছর পার হলেও এখনো হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করা হয়নি। ৯ বছরে আদালত থেকে ৭৯ বার সময় নির্ধারণ করে দেয়ার পরও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। আদৌ বিচার পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সংশয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারামুক্তির দিন ক্যামেরার প্রথম ক্লিকটি যে করতে পেরেছিল সেই ফটো সাংবাদিকের নাম শফিকুল ইসলাম কাজল। আর সেই সাংবাদিক কাজলই চোখ ও মুখ বাঁধা অবস্থায় নিখোঁজ ছিলেন ৫৩ দিন। খোঁজ পাওয়ার পর কারাগারে ছিলেন সাত মাস। প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম প্রকাশ্য দিবালোকে নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। গত মার্চ মাসে বায়তুল মোকাররম এলাকায় বিক্ষোভ-সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহ ও ছবি তোলার সময় হামলায় সাংবাদিকরা মারাত্মক মারধরের শিকার হন। ডেইলি স্টারের ফটো সাংবাদিক প্রবীর দাস ও এমরান হোসেন, প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক হাসান রাজা, বাংলাদেশ প্রতিদিনের ফটো সাংবাদিক জয়িতা রায়, বিডিনিউজ২৪-এর ফটো সাংবাদিক মাহমুদ জামান অভি, সারাবাংলার ফটো সাংবাদিক হাবিবুর রহমান, ৭১ টিভির সাংবাদিক ইশতিয়াক ইমন, বাংলাভিশনের স্টাফ রিপোর্টার দীপন দেওয়ান মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে অন্তত ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যাকান্ডের শিকার। এক দিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানারকম ভয়ভীতি-হুমকির কারণে সাংবাদিকতার পরিসর সঙ্কুুচিত হয়ে উঠছে। আরেক দিকে শারীরিকভাবে হামলা ও হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। এসব হামলা-নির্যাতন সাংবাদিকতা পেশাকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে এবং তথ্যপ্রকাশে বাধা দেয়ার মধ্য দিয়ে তা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাও খর্ব হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সাংবাদিক নির্যাতন ও সাংবাদিক হত্যার যথাযথ বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। তাই দেশের গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সাংবাদিক নির্যাতন রোধে এখনই রাষ্ট্রকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব নির্যাতনের কারনে কেউ কেউ সাংবাদিকতা ছেড়ে দিচ্ছে। কেউ বলছে আর নিউজ করবো না। কেউ বলছে রাষ্ট্রের জন্য কাজ করবো সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা কোথায় ? অপরাধীরা বলে বেড়াচ্ছে সাংবাদিক নির্যাতন করলে কিছুই হয় না। অনেক সময় কর্মকর্তাদের স্যার না বলায় লাঞ্চিত হতে হচ্ছে। ভাই বা আপা বলায় তথ্য পাচ্ছেন না। একের পর এক সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক উল্টো মামলা দিয়ে সাংবাদিকদেরই হয়রানি করা হয়। এটা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যহত হচ্ছে। নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেশে গত ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ১২০ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। নির্যাতিত সাংবাদিকদের মধ্যে ১৮ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে আক্রান্ত হন, নির্বাচনি সহিংসতায় ১৩ জন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন উপলক্ষে বিক্ষোভ ও সহিংসতায় ১৮ জন সাংবাদিক আহত হন। অন্যরা স্থানীয় প্রভাবশালী মহল, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে এক জন সাংবাদিক মারা গেছেন। গাঁছে বেধে সাংবাদিক নির্যাতন, রাতের আধারে বাড়ি থেকে সাংবাদিক গ্রেপ্তার, উলঙ্গ করে সাংবাদিক নির্যাতন এমন শিরোনাম গণমাধ্যমে অহরহ দেখতে হচ্ছে। ডিজিটাল আইন নিঃসন্দেহে জাতির নিরাপত্তা সার্থে। এই ডিজিটাল আইন সংশোধনে নানা সময় সাংবাদিকরা নানাভাবে সরকারের কাছে আবেদন করেছে। কিন্তু এখন ডিজিটাল মামলা হলে তদন্ত না করে দ্রæত গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ডিজিটাল মামলাগুলো নুন্যতম তদন্ত করে গ্রেপ্তারের বিষয়টি ভাবা জরুরী হয়ে উঠেছে। মফস্বল সাংবাদিকদের আর্থিক অবস্থা শুনলে আশ্চর্য হবেন। কেউ শখের বশে লেখেন। কেউ মেধাকে সক্রিয় রাখতে লেখেন। কেউ কেউ লেখার নেশায় পড়ে গেছেন। কেউ বেতন ভাতা পাচ্ছেন। আবার কেউ লিখেই আত্মতৃপ্তি। কেউ দ্বিতীয় পেশা হিসেবে লেখার চর্চা করছেন। বেতন ভাতা যা পাচ্ছে তার বড় অংশই খরচ হয়ে যাচ্ছে সংবাদ সংগ্রহের কাজে। এরপর যদি একজন সংবাদকর্মী হয়রানীর শিকার হয়, মামলায় পড়েন তখন তার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকে না। যে যেভাবেই এই পেশায় আসুক, প্রত্যেকেই রাওষ্ট্রের কাজ করছেন। এরা সবাই রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের সদস্য। সুতরাং এদের নিরাপত্তার কথাও রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। সুতরাং সাংবাদিকদের হয়রানী নয়, রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা প্রয়োজন। লেখক: গণমাধ্যমকর্মী, নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস রেজাউল করিম, টাঙ্গাইল।

(খোলা কলামে প্রকাশিত সব লেখা একান্তই লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে পত্রিকার কোন সম্পর্ক নেই)

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: