রিবনার জন্য মিললো না আইসিইউ বেড

প্রকাশিত: ১৬ জুলাই ২০২১, ১২:০২ পিএম
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে: আফসোস! একটি আইসিইউ’র জন্য এত আকুতি। কোথাও মিললো না প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার একটু সুযোগ। আর এভাবেই স্বজনদের চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন গৃহবধূ রিবনা বেগম। মাত্র ৪২ বছর বয়সে করোনা উপসর্গ নিয়েই তাকে চিরবিদায় নিতে হলো পৃথিবী থেকে। এমন ঘটনায় শোকে কাতর স্বজনরা। আছে ক্ষোভও। স্বামী ও ছেলে চাকরি করেন মেডিকেল কলেজে। কোভিড হাসপাতালের একটি ওটিও রয়েছে শ্বশুর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুর রহমানের নামে। এরপরও একটি আইসিইউ জোগাড় হলো না রিবনা বেগমের জন্য। তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগতে ভুগতে সন্তানদের চোখের সামনেই চিরবিদায় নিলেন মা। এমন মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী মহামারি করোনাকাল। হৃদয়বিদারক একেকটি গল্প মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। আর আইসিইউ সংকটের কারণে একে একে স্বজনহারা হচ্ছে সিলেটের মানুষ। রিবনা বেগম। দু’সন্তানের জননী। শ্বশুর ছিলেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুর রহমান। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে তিনি মেডিকেলের ‘ব্রাদার’ ছিলেন। সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন আহমদের সঙ্গেই পাক বাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করেছিলো। মাহমুদুর রহমানের ছেলে নুর মিয়া হচ্ছেন বর্তমানে সিলেট মেডিকেল কলেজে চাকরি করেন। তারই স্ত্রী রিবনা বেগম। নগরীর বাগবাড়ি তাদের বাসা। স্বজনরা জানিয়েছেন- কয়েকদিন আগে রিবনা বেগম সর্দি, জ্বরে ভুগছিলেন। এরপর তিনি সুস্থও হয়ে যান। তবে- কাশি ছিল। মঙ্গলবার রাতে তার কাশি বেড়ে যায়। কাশতে কাশতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। দেখা দেয় শ্বাসকষ্টও। ওই দিন ভোররাত ৪টার দিকে স্বামী ও সন্তানরা রিবনা বেগমকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা দেখে তাকে ভর্তি করেন ৫ তলার ৫নং ওয়ার্ডে। স্বজনরা জানিয়েছেন- ভর্তি করা হলেও কোনো ডাক্তার এসে রিবনা বেগমকে দেখেননি। এমনকি তাদের পক্ষ থেকেও কোনো চিকিৎসা দেয়া হয়নি। তবে- শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়ায় একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে সাপোর্ট দেয়া হয়। এদিকে- সকালের দিকে ডাক্তারদের দেখা মিলে। ডাক্তাররা এসে রিবনা বেগমকে দেখে করোনার নমুনা সংগ্রহ ও বুকের এক্স-রে করার পরামর্শ দেন। বুকের এক্স-রে তাৎক্ষণিকই করা হয়। এরপর নমুনাও সংগ্রহ করা হয়। সকালের দিকে ডাক্তারের দেখা মিললেও বিকাল পর্যন্ত আর কোনো ডাক্তার আসেননি। কেউ এসে রোগীর খোঁজখবরও নেননি। তারা এক্স-রে রিপোর্টও দেখেননি। এদিকে- ক্রমেই অবনতি হচ্ছিলো রিবনা বেগমের শারীরিক অবস্থা। গত মঙ্গলবার রাতে তাকে অক্সিজেন সাপোর্টে ওয়ার্ডে রাখা হয়। বার বার যোগাযোগ করা হলেও ডাক্তারের দেখা মেলেনি বলে অভিযোগ করেন স্বজনরা। এই অবস্থায় বুধবার সকালে আসেন ডাক্তাররা। তারা এসে বলেন- রোগীকে বাঁচাতে হলে আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন। তারা ধারণা করেন করোনা আক্রান্ত হয়েছে রিবনা। তার অক্সিজেন লেভেলও কমে আসছিলো। এ কারণেই দ্রুত আইসিইউতে নেয়ার পরামর্শ দেন। এরপর প্রথমেই স্বজনরা সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে একটি বেডের জন্য যোগাযোগ করেন। কিন্তু আইসিইউ ওয়ার্ড থেকে জানিয়ে দেয়া হয়- ‘আইসিইউ বেড খালি নেই।’ এ নিয়ে হাসপাতালে সংশ্লিষ্টদের কাছেও ধরনা দেন স্বজনরা। কিন্তু হাসপাতালে মেলেনি আইসিইউ। এরপর তারা যোগাযোগ করেন সিলেটের কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে। ওই হাসপাতালের একটি ওটি ওয়ার্ড রিবনা বেগমের শ্বশুরের নামে রয়েছে। স্বজনরা আশাবাদী ছিলেন- শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল হয়তো তাদের ফিরিয়ে দেবে না। কিন্তু শামসুদ্দিনে এসেও তারা হতাশ। আইসিইউ খালি নেই। একটি বেডের জন্য ডাক্তারের কাছে অনুনয় করেন। কিন্তু ডাক্তাররাও অসহায়। বেড খালি না থাকায় তারাও আইসিইউ সাপোর্ট দিতে পারেননি। ওদিকে- রিবনা বেগমের শ্বাসকষ্ট তীব্র হচ্ছিলো। সাধারণ অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে তার পরিস্থিতিও স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছিলো না। এ দৃশ্য দেখে স্বজনরা সরকারি হাসপাতালের বাইরে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও যোগাযোগ শুরু করেন। অনেক হাসপাতালে গিয়ে আইসিইউ বেড খালি আছে কিনা; খোঁজ করেন। কিন্তু কোথাও তারা পাননি একটি আইসিইউ বেড। গত বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে হাসপাতালের বেডে থাকা অবস্থায় রিবনা বেগমের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। স্বজনরা জানান- হাসপাতালের এক দালালের দাবি মতো তারা ৩০ হাজার টাকা দিতে রাজি ছিলেন। তবুও যেন একটি আইসিইউ বেড মিলে। কিন্তু আইসিইউ বেড পাওয়ার আগেই রাত সাড়ে ১০টায় স্বজনদের চোখের সামনেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন রিবনা বেগম। গতকাল বাদ জোহর রিবনার মরদেহের জানাজা শেষে নগরীর বাগবাড়িস্থ গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তবে- আইসিইউ বেড না পাওয়ায় স্বজনদের আহাজারি থামছে না। জানালেন- একটি আইসিইউ বেডের জন্য তারা অবিরাম দৌড়ঝাঁপ ও চেষ্টা করেছেন। দু’সন্তানকে চির দিনের মতো এতিম করে বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে। আইসিইউ না পেয়ে রিবনার মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন তার আত্মীয় সিলেটের খাদিমপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এডভোকেট আফসার আহমদ। গতকাল তিনি ফেসবুকের স্ট্যাটাসে প্রশ্ন রেখে উল্লেখ করেন- ‘হাসপাতালে ভর্তি বোনটি আইসিইউ সুবিধা না পেয়ে রাতে না ফেরার দেশে চলে গেল। অথচ তার শ্বশুর শহীদ মাহমুদুর রহমান ও শহীদ শামসুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে শহীদ হয়েছিলেন এই পরিবার এই সুবিধাটুকু পাওয়ার যোগ্য ছিল না?’ আরেকটি স্ট্যাটাসে তিনি উল্লেখ করেন- ‘কত আত্মীয়স্বজন পরিচিত জনের একটি আইসিইউ জোগাড় করে দেয়ার অনুরোধ কিন্তু আমি কিছুই করতে পারি নাই। হে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করো।’ রিবনার বোনের ছেলে ফয়সল আহমদ জানিয়েছেন- ‘একটি আইসিইউ’র জন্য আমরা অনেক জায়গায় গেলাম। হাতে-পায়ে ধরলাম। কান্নাকাটি করলাম। কিন্তু কোথাও একটি আইসিইউ’র জোগাড় হলো না। শেষে ওসমানীতে এক দালালের মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকায় আইসিইউ পাওয়ার জন্য চুক্তিও করেছিলাম। কিন্তু আইসিইউ পাওয়ার আগেই তার খালা রিবনা বেগম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।’ তিনি জানান-‘চোখের সামনে স্বজনের এমন মৃত্যু কোনো দিন ভুলতে পারবো না। কিন্তু সবচেয়ে আফসোসের বিষয় হচ্ছে; খালার শ্বশুর একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেও কেউই আর্তনাদ শুনলো না। এ আফসোস স্বজনদের চিরদিন তাড়িয়ে বেড়াবে বলে জানান ফয়সল।’ সুত্রঃ দৈনিক মানবজমিন

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: