উন্নয়নের ছোঁয়ায় সাত বছরে বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহল গুলোর চিত্র

প্রকাশিত: ৩১ জুলাই ২০২২, ০৮:১৬ পিএম

বিলুপ্ত ছিটমহল গুলোর উন্নয়নে গত সাত বছরে সরকারের বিশেষ নজরে বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের চিত্র। সন্ধ্যা হলেই জ্বলে উঠছে বৈদ্যুতিক বাতি। যে দিকে দৃষ্টি যায়, চোখে পড়ছে- শুধু উন্নয়নের ছোঁয়া। দীর্ঘ ৬৮ বছর পিছিয়ে থাকা বিলুপ্ত ছিটমহলে এখন সন্ধ্যায় হলেই জ্বলে উঠছে বৈদ্যুতিক বাতি। এখানকার বাসিন্দারা পাচ্ছেন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ সরকারি অনেক সুযোগ। তৈরি হয়েছে নতুন রাস্তা-ঘাট। এগিয়ে চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ। স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিলুপ্ত ছিটমহলে তৈরি করা হয়েছে ক্লিনিক। এখন বিলুপ্ত ছিটমহলের সর্বত্রই লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া।

রোববার (৩১ জুলাই) দুপুরে লালমনিরহাটের বিলুপ্ত ৫৯টি ছিটমহলে ৭তম বর্ষপূর্তিতে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে উৎসব মুখর পরিবেশে ছিটমহল বিনিময়ের লালমনিরহাটের ভিতরকুটি বাঁশপচাই, হাতীবান্ধা উপজেলার গোতামারী ও পাটগ্রাম উপজেলার বাঁশকাটা বিলুপ্ত ছিটমহলে ৭ম বর্ষপূর্তি উদযাপন হয়েছে।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার ভিতরকুটি ছিটমহলের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী এসহাক আলী জানালেন, জীবনের শেষ বয়সে ভোটার হয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে ইচ্ছে অনুযায়ী পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছি। বেঁচে থাকতে নতুন পরিচয়ে জীবনের এক অন্যরকম আনন্দ।

এদিকে জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল বাঁশ কাটার বাসিন্দা ওমর আলী দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে তাল মিলিয়ে ছিটমহলের চিত্রও পাল্টে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে জানান, নিজেদের পরিচয়টাও দিতে পারতাম না আমরা। শিক্ষা, চিকিৎসা সহ নানা সমস্যায় ভোগান্তির শেষ ছিলো না। কিন্তু ছিটমহল বিলুপ্ত ও প্রধানমন্ত্রীর নজরেই ভোগান্তির দিন ইতিহাস হয়ে গেছে। উন্নয়নের ছোঁয়া এখানকার বাসিন্দাদের জীবনমান পাল্টে দিয়েছে।

লালমনিরহাটের ভিতরকুটি বাঁশপচাই ছিটমহলের সাবেক সভাপতি হারুন ঋারশিদ বলেন, সাত বছরে আমাদের ছিটমহল ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বিদুৎ, মসজিদ, মন্দির বয়স্ক ভাতা বিধবা ভাতার রাস্তা ব্রীজ কালভার্ট এর ব্যাপক উন্নত হয়েছে। পাশাপাশি ছিটমহলবাসী বিশেষ কোটায় চাকরি এবং কৃষকরা কৃষি ঋন থেকে বঞ্চিত। এই সুযোগ সুবিধাগুলো পেলে ছিটমহলবাসী আরো উন্নত হতো।

জানা গেছে, ভারত-বাংলাদেশ সরকার যৌথ ঘোষণায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ছিটমহলের নামে স্ব স্ব দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে থাকা ভূখন্ডগুলো দেশের মূল ভূখন্ডের সাথে একিভূত হয়। ফলে ওইদিন থেকে ব্রিটিশদের করে রাখা ছিটমহলের বিলুপ্তি ঘটে।

জেলার পাটগ্রাম উপজেলায় বিলুপ্ত ছিটমহলের সংখ্যা বেশি। এ উপজেলায় ৫৫ টি বিলুপ্ত ছিটমহলের মধ্যে জনবসতিপূর্ণ রয়েছে ৩৮ টি। একাধিক বিলুপ্ত ছিটমহল গুলো ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার বাসিন্দাদের জীবন-যাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়নে প্রতি বছরে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে সরকার। সরকারি উদ্যোগে বিলুপ্ত ছিটমহল গুলোতে পাকা রাস্তা, ডিজিটাল সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিক, পুলিশ ফাঁড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান, শ্মশান, ব্রীজ, কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ, স্যানিটেশন, সুপেয় পানির জন্য টিউবওয়েল, কমিউনিটি সেন্টার, সোলার প্রদান করা হয়েছে। বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্তা নারী, প্রতিবন্দীদের জন্য করে দেওয়া হয়েছে ভাতার কার্ড। তাছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৬ টি ভুমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।

১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমান্ত চুক্তি মোতাবেক বর্তমান প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১ টি ও ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১ টি ছিটমহলের বিলুপ্তি ঘটে। সেই সুবাদে উভয় দেশের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহল গুলো দেশের মূল ভূ-খন্ডের সাথে যোগ হয়। এতে ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দারা বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দারা ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভ করে।

চুক্তির সফল বাস্তবায়নের পর বাংলাদেশের মানচিত্রে যোগ হয় ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর জমি। পাটগ্রাম উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী মাহবুব আলম জানান, ‘গত ৭ বছরে বিলুপ্ত ছিটমহলে প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৩ টি ব্রীজ, ২টি মসজিদ, ১টি মন্দির, ১টি শ্বশান, কবরস্থানের বাউন্ডারী ওয়াল, কমিউনিটি সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় নর্মাণ করা হয়েছে।পাটগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পাটগ্রাউপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল সমূহে প্রায় ১ হাজার নলকুপ, দুই শত রিংওয়েল নলকুপ, ৮ শ স্বাস্থ্য সম্মত ল্যাট্রিন স্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষা অধিদপ্তর জানায়, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষায়িত ১৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের আওতায় বিলুপ্ত ছিটমহলে চারটি বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

বিলুপ্ত ছিটমহলের ৮ নং ভোটবাড়ী, ১৪ নং লতামারী, ২১ নং পানিশালা ও ১১৯ নং বাঁশকাটা বিদ্যালয় বিহীন এলাকায় চার কক্ষ বিশিষ্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় উদ্যোগে তিনটি নিন্ মাধ্যমিক ও দুইটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাশঁকাটা দয়ালটারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মোমিনপুর বাশঁকাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবারেই এমপিও ভুক্তি হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে ইতিমধ্যে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪০ কিমি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় সকল বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ছিটমহল বিলুপ্তির ৭ বছর পূর্তি ও ছিটমহল বিলুপ্তির দিনটি পালনে এখানকার বাসিন্দা ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়।

রোববার (৩১ জুলাই) দুপুরে বাঁশকাটা কমিউনিটি ক্লিনিকে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোতাহার হোসেন, বিশেষ অতিথি ছিলেন পাটগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রুহুল আমীন বাবুল। এছাড়াও মসজিদে মিলাদ মাহফিল ও মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা, রাতে মোমবাতি প্রজ্বলনের আয়োজন করা হয় বলে জানান, ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির নেতা নজরুল ইসলাম ও বিলুপ্ত ছিটমহল উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি গোলাম মতিন রুমি।

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে ৬৮ বছরের বন্দী জীবনের অবসান ঘটে ভারত-বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহলের কয়েক হাজার মানুষের। এর মধ্যে ১১১টি বাংলাদেশের এবং ৫১টি ভারতের ভূ-খন্ডের সাথে যুক্ত হয়। বাংলাদেশের ১১১টির মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি, লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগ্রাম জেলায় ৩৬টি এবং নীলফামারী জেলায় রয়েছে ৪টি বিলুপ্ত ছিটমহল। লালমনিরহাট জেলার ৫৯টি বিলুপ্ত ছিটমহলের মধ্যে সদর উপজেলায় ২টি, হাতিবান্ধা উপজেলায় ২টি ও বাকি ৫৫টির অবস্থান পাটগ্রাম উপজেলায়।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: