সিংড়ায় পূর্ব বিরোধের জেরে বাড়িঘর-দোকানপাট ভাংচুর

প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:০০ পিএম

পূর্ব বিরোধের জেরে নাটোরের সিংড়া উপজেলার ইটালি ইউনিয়নের পাকুরিয়া গ্রামে সাবেক ইউপি সদস্য আলিফ হোসেনের নেতৃত্বে বর্তমান ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেনের দলীয় কার্যালয় ও আশেপাশের দোকানপাটে ব্যাপক ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সোমবার বিকেল থেকে কয়েক ঘন্টাব্যাপী চলা এ তান্ডবে সাতটি দোকানঘর ও দুইটি বাড়ি ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়।

হামলাকারী সাবেক ইউপি সদস্য আলিফ হোসেন সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের জৈষ্ঠ্য যুগ্ম সাধারন সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলামের অনুসারী। অপরদিকে, হামলার শিকার ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেন উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফিকের অনুসারী। ঘটনার পর এলাকাবাসী ৯৯৯ এ কল করলেও পুলিশ দেরীতে সাড়া দিয়েছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। হামলার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলামকে দায়ী করেছেন ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেন।

এদিকে, হিন্দু সম্প্রদায়ের আইনজীবীরসহ কয়েকটি দোকানপাট ও বাড়ি ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলামকে দায়ী করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের স্ত্রী আরিফা জেসমিন কণিকা। তিনি হামলা ও ভাংচুরের ঘটনায় আরিফের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানান।

জানা যায়, ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বর্তমান চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফিকের পক্ষে কাজ করেন ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেন। অপরদিকে, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আদেশ আলী সরদারের পক্ষে কাজ করেন সাবেক ইউপি সদস্য আলিফ হোসেন। ওই নির্বাচনে শফিক জয়লাভের পেছনে জাহাঙ্গীরকে দায়ী করে প্রচার করতে থাকেন আলিফ হোসেন। এই ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলামও জাহাঙ্গীরের প্রতি ক্ষিপ্ত ছিলেন। এ নিয়ে আরিফুল ও আলিফের সাথে জাহাঙ্গীরের বিরোধ তৈরী হয়।

এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, তিন বছর আগের ওই ঘটনার জের গড়ায় স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম নিয়োগে। রোববার রাতে ইউপি চেয়ারম্যান আরিফের অনুসারী ব্যক্তিকে মসজিদের ইমাম নিয়োগ দেয়া হলে বর্তমান ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর ক্ষুদ্ধ হন। এ ব্যাপারে কৈফিয়ত চাইতে গেলে জাহাঙ্গীরের সাথে আরিফ অনুসারী আলিফের লোকজনদের হাতাহাতি হয়। এ ঘটনায় সোমবার সকালে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে সিংড়া থানায় অভিযোগ করেন আলিফ। সোমবার দুপুর থেকেই ইটালী ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের আশেপাশে লোকজন জমা হতে থাকে। সিংড়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ভাড়া করে ট্রাক, টেম্পু যোগে দুই থেকে আড়াইশো বহিরাগত ব্যক্তি পাকুড়িয়ায় ঢুকে বিকাল ৪ টা থেকে কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত তান্ডব চালায়।

এসময় আতংকে মানুষ ছুটোছুটি করতে থাকে। ঘটনার সময় আহসান হাবিবের ইলেকট্রনিকস দোকান, হাসান আলীর স্টেশনারী দোকান, ভুট্টোর চা দোকান, রানার হোটেল, ফরিদের চায়ের দোকান ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। হামলাকারীরা স্থানীয় টিপু ও আব্দুল আজিজের বাড়ি ভাংচুর করে। এসময় বর্তমান ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীরের অফিস ভাংচুর করা হয়।

হামলাকারীদের বাধা দিতে গেলে চা-বিক্রেতা রনি হোসেনকে ঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে হামলাকারীরা বাজারের পাশের বাসিন্দা আইনজীবী মানিক লাল চক্রবর্তীর বাড়িতে হামলা করেন। এ সময় মানিক লালের কার্যালয়ের আসবাব ও নথিপত্র তছনছ করা হয়। এ সময় প্রতিবাদ করলে মানিক লালের ছোট ভাই ও সাবেক ইউপি সদস্য এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তা লাল চক্রবর্তীকে মারধর করা হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা তাণ্ডব চালানোর পর হামলাকারী ব্যক্তিরা সন্ধ্যা ছয়টার দিকে গ্রাম ছেড়ে যান। পরে সিংড়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সন্ধ্যার পর নাটোরের পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

মানিক লাল চক্রবর্তী বলেন, গত উপজেলা নির্বাচনে আমরা নৌকার প্রার্থী শফিকুল ইসলামের পক্ষে ছিলাম। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা আদেশ আলী সরদারের পক্ষ নেন। এ ছাড়া গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ইটালি ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে আমরা জাহাঙ্গীর হোসেনের পক্ষে ভোট করি। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাবেক সদস্য আলিফ হোসেন। এসব কারণে ইটালি ইউপির চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম ও তাঁর সমর্থকেরা আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। আমাদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে তারা সেই ক্ষোভ মেটালেন। আমরা ৯৯৯এ কল করলেও পুলিশ সময়মতো এসে সাহায্য করেনি।'

সাবেক ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আলিফের নেতৃত্বে শত শত বহিরাগত আমার দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর করেছে। ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুল এই হামলার নির্দেশদাতা। গত ইউপি নির্বাচনে জয়ের পর থেকে ইটালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুর ইসলাম আরিফ আমাকর পদত্যাগপত্র দিতে বলেন। তা না হলে দেখে নেয়া হবে বলে হুমকি দেন। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল তাঁর লোকজন তান্ডব চালিয়েছে।

অভিযোগের ব্যাপারে অভিযুক্ত ইটালি ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ মিথ্যা। হামলার বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। আমি উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আমার বিরুদ্ধে বিগত নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী মদদ দেবার অভিযোগ তুলেছেন প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী কণিকা। অথচ দলীয় ফোরামে তিনি কখনো এমন অভিযোগ করেননি। কণিকা মনে করছেন আগামীতে আমি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেবো। কিন্ত কণিকা তার ভাই লুৎফুল হাবিব রুবেলকে চেয়ারম্যান বানাতে চান। তাই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছেন।

এ ব্যাপারে সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, পূর্ব বিরোধের জেরে দুই ইউপি সদস্যের কর্মীদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। এর বেশি কিছুই না। সেখানে হিন্দু পরিবারের কারো বাড়িঘর ভাঙা হয়নি৷ ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।

সিংড়া থানার ওসি নূরে আলম সিদ্দিক বলেন, ঘটনাস্থল থেকে সিংড়া থানার দুরুত্ব প্রায় দেড় ঘন্টা। আমরা ৯৯৯ থেকে কল পাবার পরই ফোর্স পাঠাই। কিন্ত দুরুত্বজনিত কারনে দেরি হয়। উভয় পক্ষকে মামলা করার পরামর্শ দেয়া হলেও এখনো কোন পক্ষই মামলা বা অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে ঘটনার তদন্ত করা হবে৷ তবে অতিরিক্ত পুলিশ ওই এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: