স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ডনকে আহ্বায়ক করে শ্রমিকলীগের কমিটি

প্রকাশিত: ০৮ অক্টোবর ২০২২, ১০:২৬ পিএম

বিতর্ক এবং সমালোচনা যেন শেষ হচ্ছে না কক্সবাজার আ’লীগ ও অঙ্গসংগঠনের। ডজনের বেশি ইয়াবা কারবারিকে দিয়ে টেকনাফ পৌর আ’লীগের কমিটির পর এবার একই পথে হাটছে শ্রমিকলীগও। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা ডন শাহজাহান মিয়াকে আহ্বায়ক করে টেকনাফ উপজেলা শ্রমিকলীগের কমিটি ঘোষণা করেছে জেলা শ্রমিকলীগের বির্তকিত কমিটি। ঘোষিত ২১ সদস্যের ওই কমিটির অধিকাংশই ইয়াবা কারবারি বলে অভিযোগ রয়েছে। এরপর থেকেই আ’লীগসহ অঙ্গসংগঠনের সাধারণ কর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, কোটি টাকার বিনিময়ে টেকনাফ উপজেলা শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে যুবদল নেতা সাহেদুল আলম রানার কথিত শ্রমিকলীগের জেলা কমিটি। এতে ইয়াবা ডন শাহজাহান মিয়াকে আহ্বায়ক এবং ফয়েজ উদ্দিন জিকুকে সদস্য সচিব করা হয়। তবে ঘোষিত কমিটির বির্তক এড়াতে জেলা শ্রমিকলীগের আহ্বায়ক রানা এবং সদস্য সচিব মো: ফয়সাল চৌধুরীর স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি ঢালাওভাবে প্রচার করেনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টেকনাফ সীমান্তের একজন বড় মাপের ইয়াবা কারবারি মোঃ শাহজাহান মিয়া (৩৫)। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৯ নম্বর তালিকাভুক্ত ইয়াবাকারবারি। শাহজাহান সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ‘বাম হাত’ এবং তার পিতা জাফর আহমদ ‘ডান হাত’ হিসাবে পরিচিত। শাহজাহান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৬ নম্বরের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি এবং এক সময়ের প্রতাপশালী বিএনপি নেতা জাফর আহমদের ছেলে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেকনাফ সদরের লেঙ্গুরবিল নামক এলাকার বাসিন্দা শাহজাহান ছাত্রজীবন থেকে পিতার রাজনীতির সূত্র ধরে তিনিও বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি এলাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের উপর প্রভাব খাটাতেন বেশ। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে ওই সময়ে উখিয়া-টেকনাফ আসনের সাংসদ আব্দুর রহমান বদির হাত ধরে পিতা বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিবাদের মুখেও সাংসদ বদি বিএনপির সাবেক এই নেতাকে দলে এনে শেষমেষ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ ধরিয়ে দেন।

এদিকে পিতার দল বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে সক্রিয় তার তিন ছেলেও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনে ঠাঁই করে নেন। সময়ের বিএনপির প্রভাবশালী এই পরিবারটি দলবদল করে আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরিক্ষীত নেতাকর্মীদের দলিয়ে পিষিয়ে আওয়ামী লীগেও প্রভাব বিস্তার করে। দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাদের পেছনে ফেলে নব্য আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান মিয়া জাতীয় শ্রমিক লীগের উপজেলা সভাপতির পদ ভাগিয়ে নেন।

বিএনপি সরকারের আমলে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ নেতা হয়ে টেকনাফে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল জাফর পরিবার। সীমান্তের ইয়াবা কারবার থেকে শুরু করে সর্বত্র আধিপত্য বিস্তার করছিল পিতা পুত্রের সন্ত্রাসী গ্যাংটি। পিতার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মূল নেতৃত্বে থাকতো ছেলে শাহজাহান মিয়া ও তার বড়ভাই দিদার মিয়া। রাজনৈতিক প্রভাব ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের পাশাপাশি সমানতালে ইয়াবা কারবারেও আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে টেকনাফের শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা দিন দুপুরে দেদারছে চালিয়েছে ইয়াবা কারবার।

জাফরের দুই ছেলে শাহজাহান ও দিদার মিলে নিজেরাই ইয়াবা সিন্ডিকেট গড়ে তোলার পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ইয়াবা কারবারিদের শেল্টারদাতা হিসেবে ভূমিকা রাখেন। গত ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শাজাহান মিয়া চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে সাংসদ বদির বদান্যতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি নিজ এলাকার ইয়াবা কারবারিদের ত্রাতা হিসেব ভূমিকা রাখার পাশাপাশি পরিবারের এবং তার নিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেটের ইয়াবা কারবারে লীড দিয়ে আসেন। তাদের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অনুগত ইয়াবা কারবারিরাও আরো বেপরোয়া গতিতে লাগামহীনভাবে ইয়াবা কারবার চালিয়ে যান। পরবর্তী শাহজাহান ইয়াবা বিরোধী অভিযানে গ্রেফতার এড়াতে এলাকা ত্যাগ করে ভারতে পালিয়ার সময় বেনাপুল সীমান্তে ধরা পড়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির হাতে। সেসময় তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ইয়াবা এবং অস্ত্র। বর্তমানে তার ঝুলিতে মাদক-অস্ত্রসহ অর্ধ ডজনের মত মামলা রয়েছে।

তবে শাহজাহান মিয়ার দাবি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কারণে তিনি মাদক মামলার আসামী হয়েছেন। গোয়েন্দা সংস্থার সাথে তার সম্পর্ক ভাল না থাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন তালিকায় তার নাম এসেছে।

এদিকে দলীয় সূত্র জানান, জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম সিকদার সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর সাবেক যুবদল নেতা শাহেদুল আলম রানাকে আহবায়ক করে কথিত আহবায়ক কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। এই কমিটি ঘোষণা করে কক্সবাজারে শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। এরই প্রেক্ষাপটে গত ২২ ডিসেম্বর কক্সবাজারের আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে রাজধানী ঢাকায় দলীয় কার্যালয়ে এক বৈঠকে এই নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় যে, শ্রমিক লীগ কক্সবাজার জেলা শাখার প্যাডে কেন্দ্রীয় সভাপতির স্বাক্ষরবিহীন শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরে কক্সবাজার জেলা শ্রমিকলীগের যে আহবায়ক কমিটি দেওয়া হয়েছে তা বাতিল করে পূর্বের নির্বাচিত কমিটির ১নম্বর সহ-সভাপতিকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করে শ্রমিক লীগ কক্সবাজার জেলা শাখা পূর্বের মতো সকল সাংগঠনিক দায়িত্ব পরিচালনা করবে।

যদিও বা এরপর থেকে যুবদল নেতা রানা এবং ফয়সার চৌধুরী নিজেদের ওই কমিটির নেতা দাবী করে কমিটি বানিজ্যসহ নানা বির্তকিত কর্মকান্ড চালিয়ে শ্রমিকলীগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে চিহ্নিত মাদক কারবারিসহ বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে পূর্নবাসন করার চেষ্টা করছেন। এবং নিজেদের পকেট ভারী করছেন। এমটাই দাবী শ্রমিকলীগের একাংশের।

কক্সবাজার জেলা শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক সফিউল্লাহ আনসারী বলেন, ‘দুবৃত্তদের গুলিতে আমার সভাপতি খুন হওয়ার পর থেকে যুবদল নেতা শাহেদুল আলম রানাকে সামনে রেখে অগঠনতান্ত্রিকভাবে আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন আনে একটি পক্ষ। পরে ওই কমিটি বাতিল করে পূর্বের কমিটি পুনর্বহাল রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে শ্রমিকলীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছে শাহেদুল আলম রানা। আর তাকে লেলিয়ে দিয়ে নষ্ট রাজনীতির হলি খেলা শুরু করেছেন জেলা আ.লীগের শীর্ষ এক নেতা।’

তিনি আরোও বলেন, ‘শাহজাহান মিয়া পড়ালেখা শেষে ঢাকা থেকে টেকনাফ ফিরলে সাবেক এমপি আব্দু রহমান বদির অনুরোধে তাকে টেকনাফ উপজেলা শ্রমিকলীগের সভাপতি করেছিলাম। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত হলে ওই কমিটি ভেঙ্গে দিই। শাহজাহান পুনরায় কমিটি পেতে কোটি টাকার অফার নিয়ে একাধিবার যোগাযোগ করলেও তাকে কমিটি দিয়ে দলকে আর কলংকিত করিনি। কারণ এই দলের জন্য জীবন-যৌবন শেষ করেছি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা শ্রমিকলীগের আহ্বায়ক দাবি করা শাহেদুল আলম রানা অনেকটা মাদক ব্যবসায়ীর সুরে বলেন, ‘শাহজাহান মিয়া একজন খুব ভাল ছেলে। তাকে মাদক বিক্রি করতে কখনো দেখিনি। প্রতিপক্ষের লোকজনই তাকে মাদক কারবারি বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন।’

জাতীয় শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নুর কুতুব আলম মান্নান বলেন, ‘শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরে ভুল বশতে কক্সবাজার জেলা শ্রমিকলীগের একটি আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়েছিলো। পরে তা বাতিল করে পূর্বের নির্বাচিত কমিটিকে বহাল রাখা হয়। বাতিল হওয়ার পরও এখন যদি কেউ ওই কমিটির নেতা দাবী করে বির্তকিত কর্মকান্ড করে থাকে তারা খুব অন্যায় করছে।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: