পুলিশের সামনেই চলছে ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি, বসছে জুয়া ও মাদকের আসর

প্রকাশিত: ০৫ নভেম্বর ২০২২, ১২:১৮ এএম

পূর্বাঞ্চল রেলপথের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে জংশন আখাউড়া। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এ রেলওয়ে জংশন। এ রেলপথের অন্যান্য স্টেশনের চেয়ে আখাউড়া স্টেশনের রাজস্ব আয় বেশি হলেও যাত্রীসেবার মান নেই বললেই চলে। এ স্টেশনে আন্তঃনগরসহ অন্যান্য ট্রেনের যাত্রী সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও প্রতিনিয়ত কমেছে আসন যুক্ত আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট।

আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আখাউড়া জংশন ঘিরে গড়ে ওঠেছে একাধিক টিকিট কালোবাজারি চক্রের অপতৎপরতা। এ কারণে সাধারণ যাত্রীদের নাগালের বাইরে থাকছে ট্রেনের টিকিট। অপর দিকে বিশাল এড়িয়া জুড়ে জংশন এলাকা হওয়ায়, রেলওয়ে থানা মূল স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে। থানা এলাকায় রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের অফিস রয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের তেমন সমাগম নেই। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সেখানে গড়ে উঠেছে মাদক ও জুয়ার আসর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আখাউড়া স্টেশনে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি চক্রের পেছনে সহযোগী হিসাবে কাজ করছেন রেলওয়ে পুলিশ, রেলস্টেশনের বুকিং সহকারীরা সহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থা। আর থানার পাশেই অবস্থিত লাল হোসেন ইনিস্টিউট চত্বরের বাংলাদেশ রেলওয়ে এমপ্লয়ীজলীগ কার্যালয় কক্ষে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বসে মাদক ও জুয়ার আসর। এ ব্যাপারে অবগত হলেও একে অন্যের দায়িত্ব বলে অজানা কারণে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা রেলওয়ে থানার ও বেঙ্গল থানা পুলিশ।

ভুক্তভোগী যাত্রীরা জানান, আখাউড়া স্টেশনে ট্রেনের টিকিট যাত্রার ৫ দিন আগে অনলাইনে ও স্টেশন কাউন্টারে বিক্রি করা হয়। এখন নির্ধারিত মোট আসনের ৫০ শতাংশ অনলাইনে এবং ৫০ শতাংশ কাউন্টারে বিক্রি করা হচ্ছে। সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ, টিকিট বিক্রি শুরুর অল্পসময়ের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়। বিশেষ করে আখাউড়া থেকে ঢাকামুখী আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিটের ব্যাপক সংকট দেখা যায়।

তবে কাউন্টারে টিকেট না পাওয়া গেলেও কাউন্টারের সামনেই ২-৩গুন দামে প্রতিনিয়ত বিক্রি হয় টিকেট। যদিও আখাউড়া রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ চেলেঞ্জ করেছেন উনি আসার আগে কালোবাজারি হলেও উনি আসার পর কালোবাজারি বন্ধ রয়েছে। তবে গত ২ ও ৩ নভেম্বর সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় ঠিক তার উল্টো, আগের তুলনায় টিকেট নিয়ে যাত্রীদের ভোগান্তি এখন আরো বেড়েছে। কালোবাজারি ছাড়া এখন আর কাউন্টারে তেমন একটা পাওয়া না অন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট। এবং কালোবাজারিদের টিকেট বেচতে দেখা যায় মূল ফটকের সামনেই।

আখাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশন টিকিট কালোবাজারিতে জড়িত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টিকিট কালোবাজারিদের সঙ্গে আখাউড়া পৌর এলাকার কয়েকটি কম্পিউটারের দোকান, স্টেশন কাউন্টার এর সামনে অবস্থিত দোকান সহ আশেপাশের এলাকার একদল যুবক জড়িত। তারা অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর সংগ্রহ করে অনলাইনে টিকিট সংগ্রহের পাশাপাশি বেশি দাম দিয়ে স্টেশনের বুকিং সহকারীসহ আরও কয়েকজনের সহযোগিতায় দিব্যি চাহিদামতো টিকিট পেয়ে যাচ্ছেন। রেলওয়ে পুলিশ, ডিএসবি, আরএনবি, আরএসবি, সিআইডি সহ কয়েকজায়গায় টাকা পৌঁছে দিয়েই নিজেদের জন্য সামান্য লাভ রেখে সেসব টিকিট তারা চড়া দামে বিক্রি করছেন।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আখাউড়া রেলওয়ে থানার আশেপাশের দোকানদান ও এক পুলিশ কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, জুয়ার আসরে বসা সবাই রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতা এবং স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন। এখানে প্রতিদিন লক্ষলক্ষ টাকার জুয়া খেলা হয় আর তা চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। জুয়ার পাশাপাশি মাদক সেবনও চলে প্রতিদিন।

এদিকে বহিরাগত লোকদের আনাগোনা খুব কম, তবু যারা আসে তাদের কর্মকান্ড চোখে চোখে রাখতে রয়েছে লোকজন। এইসব কিছু থানার পাশে হলেও থানার পুলিশের সাথে তাদের যোগসাজশ থাকায় তারা কোন বাধা দেন না। যদিও রেলওয়ে পুলিশ বলছে থানার বাইরে ১০ ফুট এড়িয়ার ভিতর কি হচ্ছে তা দেখার দায়িত্ব আমাদের, তার বাইরে না। আর আখাউড়া থানা পুলিশ বলছে, ওইটা রেলওয়ের জায়গা, রেলওয়ে থানার সামনে চলছে এইসব এইটা তাদের দেখার দায়িত্ব।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-নোয়াখালী ও ময়মনসিংহ রেলপথে চলাচলকারী আন্তঃনগর ২২টি ট্রেন আখাউড়ায় যাত্রাবিরতি রয়েছে। সেই সঙ্গে আছে মেইল ও লোকাল ট্রেনের যাত্রাবিরতি। এ স্টেশন থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার যাত্রী আন্তঃনগর মেইল লোকাল ট্রেন দিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই স্টেশন দিয়ে ভ্রমণ করছেন। তবে যাত্রীদের অভিযোগ এই স্টেশনে আন্তঃনগর ট্রেনের চাহিদানুযায়ী আসন যুক্ত টিকিট নেই। অথচ প্রত্যেকটি ট্রেনে আসনের দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি যাত্রী দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করছে। আখাউড়া থেকে ঢাকা মুখি আন্তঃনগর মেইল গুলোর শোভন চেয়ারের ভাড়া ১২০ থেকে ২০০ টাকা, স্নিগ্ধা চেয়ারের ভাড়া ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকা। তবে কালোবাজারিদের হাতে গেলেই তা হয়ে যায় যথাক্রমে ২০০ থেকে ৪৫০ টাকা এবং ৬০০ থেকে ৮৫০ টাকা। বিশেষ দিন বা ঢাকায় সরকারি চাকরির পরীক্ষার তারিখ থাকলে কালোবাজারে এই টিকিটের দাম আরও বেড়ে যায়।

এসব ব্যাপারে জানতে ৩নভেম্বর আখাউড়া রেলওয়ে থানায় গিয়ে অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আলীম শিকদারকে না পেয়ে উনার সরকারি নাম্বারে একাধিক বার ফোনকল দিলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। পরে ৪ নভেম্বর আবার ফোনকল দিলে তিনি অন্য একটি এই নাম্বার থেকে পরে কলব্যাক করেন এবং টিকেট কালোবাজারি নিয়ে প্রতিবেদককে চেলেঞ্জ করে বলেন, আমি আসার আগে এখানে টিকেট কালোবাজারি হলেও এখন কোন কালোবাজারি হয় না। আর থানার পাশে জুয়া ও মাদক খেলার ব্যাপারে বলেন, এইটা আমার দেখার বিষয় না এইটা বেঙ্গল পুলিশের দায়িত্ব আপনি তাদের সাথে কথা বলুন।

আখাউড়া থানার অফিসারের ইনচার্জ মোঃ আসাদুল ইসলামের কাছে এই ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রেলওয়ে থানার পাশে জুয়া খেলা ও মাদক সেবনের এই অভিযোগটি আমি আগেও পেয়েছি এবং একবার গিয়েও ছিলাম। কিন্তু ওইটা রেলওয়ের জায়গা এবং রেলওয়ে থানা ঘেঁষে, তাই এইটা দেখবালের দায়িত্বও তাদের। যদি তারা না পারে আমাদের অবগত করুক, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিব। এর কিছুক্ষন তিনি আবার ফোন করে জানান, আমি আপনার ফোন পাওয়ার পর এখন ঘটনাস্থলে এসেছি, আমি এখন ক্লিয়ার বলছি এইটা রেলওয়।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: