হেমন্তকালে ঘুরে আসুন বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলে, দেখুন নয়নাভিরাম দৃশ্য
শুরু হয়েছে হাওর পাড়ের শুকনো মৌসুম। হাওরাঞ্চলে একটি প্রবাদ আছে “বর্ষায় নাও হেমন্তে পাও” এর অর্থ হলো হেমন্ত কালে পায়ে হেটে আর বর্ষায় নৌকায় হাওর ঘুরে দেখা যায়। কার্তিক থেকেই শুরু হেমন্তকাল। এই হেমন্তে হাওর এলাকায় বেড়াতে যেতে পারেন। হাওর আছে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের মৌলভীবাজার জেলায়। হেমন্তে হাওর থেকে জল সরতে শুরু করে। এ সময় হাওরের যেদিকে যাবেন দুই চোখ যেন খুঁজে পাবে সবুজের রূপ। যেন এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। তেমনি হাওরাঞ্চলে চিত্র নিয়ে আজকের সরজমিন প্রতিবেদন।
মিঠামইন ও ইটনা: কিশোরগঞ্জের এই দুই উপজেলা হাওরের মধ্যে। ঢাকা থেকে সড়ক পথে বাসে নয়তো রেলে কিশোরগঞ্জ নেমে অটোরিকশায় করে চামড়া বন্দরে আসুন। এখানে ট্রলার, লঞ্চ, নৌকাসহ সবই রয়েছে মিঠামইনে যাওয়ার। লঞ্চ সরাসরি ইটনাতেও যায়। ট্রলার ও লঞ্চ ছাড়ে আধা ঘণ্টা পর পর। প্রথমে আসুন মিঠামইনে। চারদিকে বাঁধ দিয়ে বেশ সুন্দর করা হয়েছে মিঠামইন সদর উপজেলাকে। এখানে রাত যাপন করার জন্য ডাকবাংলো পাবেন।
এ ছাড়া অনুমতি নিয়ে সরকারি বিভিন্ন দফতরের গেস্ট হাউসে থাকা যাবে। মিঠামইনে বিশাল কাঠের বাজার দেখবেন। এখানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতেই মনে পড়বে-‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা/হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা/সন্ধ্যা প্রদীপ তোমার হাতে-মলিন হেরি কুয়াশাতে/কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ-বাষ্পে মাখা’ কবিতার এই চরণগুলো। হেমন্তে মিঠামইনের হাওরে কোথাও কোথাও জল আছে, সেখানে নৌকায় উঠে দূরে বহুদূরে চলে যান। নয়ন ভরে দেখে নিন হাওরের প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। এখানে দেখবেন প্রায় প্রতিটি বাড়ির চারদিকে পানি আর পানি।
চামড়া বন্দর থেকে সরাসরি লঞ্চে ইটনায় যাওয়া যাবে। সময় লাগবে দেড় ঘণ্টা। ইটনার উত্তরে শনির হাওর, ধনপুরের হাওর। আবার ইটনা থেকে লঞ্চ ও ট্রলার সুনামগঞ্জের শুল্লা ও দিরাইয়ের দিকে যায়। এ ছাড়া লঞ্চ ও ট্রলার নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি, আটপাড়ার দিকে চলাচল করে। ইটনায় রাত যাপন করার জন্য ডাকবাংলো পাবেন। হেমন্তকালে এখানের হাওর থেকে পানি সরে যায়। ইটনায় দেখবেন বাগাশাহী মসজিদ, দেওয়ান বাড়ি, গুপ্ত বাড়ি, গুরুদয়াল সরকারের বাড়ি।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মহেশগুপ্তের জমিদার বাড়ি-যা কিনা ইটনায় অবস্থিত। কাটহরি গাঁয়ে গুরু দয়াল সরকারের বাড়ি। ঘুরতে ঘুরতে আসুন জয়সিদ্ধি গ্রামে। এখানে জন্মেছিলেন আনন্দ মোহন বসু। তার নামেই তো ময়মনসিংহে রয়েছে বিখ্যাত ‘আনন্দ মোহন কলেজ’। এই জয়সিদ্ধি গ্রামে আনন্দ মোহন বসুর স্মৃতিবিজড়িত এক একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত তার পৈতৃক বাড়িটি দেখতে পাবেন। আনন্দ মোহন বসুর বাবা কর্মসূত্রে ময়মনসিংহ শহরে বসবাস করতেন। সে কারণে তার স্কুল জীবন কেটেছে ময়মনসিংহ শহরের হার্ডিঞ্জ স্কুলে (বর্তমানে জিলা স্কুল)।
১৮৬২ সালে এই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি নবম স্থান অধিকার করেন। পরবর্তী সময়ে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা শেষ করে ইংল্যান্ডের ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেন। বার এট ল উপাধি নিয়ে দেশে এসে আনন্দ মোহন আইন ব্যবসায় নিয়োজিত হন। ১৮৮৩ সালে ময়মনসিংহে তার পৈতৃক বাড়িটি দান করে সেখানে স্কুল গড়ে তোলেন। কয়েক বছর পরে এটি কলেজ হয়। ১৯০৬ সালে তার মৃত্যুর পর কলেজটির নাম রাখা হয় ‘আনন্দ মোহন কলেজ’।
হয়তো এসব কথা আগে জানা থাকলে আপনি জয়সিদ্ধি গ্রাম দেখে বলবেন, বহুদিনের স্বপ্ন যে আজ পূরণ হলো। ইটনার নন্দীবাড়িতে এক সময় বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের পৈতৃক বাড়ি ছিল। এখন এখানে তাদের বংশধরদের কেউ নেই, বাড়িটি অন্যদের দখলে। লঞ্চে উঠে শনিরহাওর ও হাইলার হাওর হয়ে সুনামগঞ্জের সাচনায় যাওয়া যায়। বর্ষাকালে এসব হাওর দিয়ে লঞ্চ ও ট্রলার যখন চলবে তখন কূল-কিনারার দেখা মিলবে না। ইটনা থেকে ট্রলারে নেত্রকোনার খালিয়াজুড়িও যেতে পারবেন। সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। ৫০০ টাকায় ট্রলার ভাড়া করে খালিয়াজুড়ি যাওয়া যাবে।
মিঠামইনের দর্শনীয় স্থান: এখানের দর্শনীয় স্থান হলো দিল্লির আখড়া, গুদর গোস্বামের আখড়া ও বিতংগলের আখড়া। এসব আখড়ায় দেখবেন হিন্দুদের দেব-দেবীর মূর্তি। পৌষ মাসে এসব আখড়ায় পূজাপার্বণ ছাড়াও কীর্তন গান হয়। দুর্গাপূজায় আখড়াগুলো নব সাজে সজ্জিত হয়ে ওঠে। মালিকের দরগা আছে এই মিঠামইনে। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের ২৫, ২৬ ও ২৭ তারিখে এখানে ওরস উদযাপিত হয়। সন্ধ্যার পর মিঠামইন বা ইটনার দিকে গেলে দূর থেকে মনে হবে হাজার বাতি যেন আলোকিত করে তুলেছে হাওরের এই দুই উপজেলাকে। কখনও বা মনে হবে, এ যেন একেকটি দ্বীপ।
অষ্টগ্রাম: বিশাল ৮টি গ্রাম নিয়ে অষ্টগ্রাম। উপজেলা সদর থেকে বাইরের গ্রামে যাওয়ার জন্য নৌকা রয়েছে। গ্রামের নাম বাংগালপাড়া, লাউড়া, আবদুল্লাহপুর, আদমপুর ও আলী নগর। বর্ষাকালে অষ্টগ্রাম দ্বীপের মতো রূপ নেয়। প্রতিটি বাড়ির চারদিকে দেখা মেলে অথৈ জল। মাঝখানে একেকটি পাড়া। অষ্টগ্রামে দর্শনীয় স্থান হলো কুতুব মাজার, কুতুবশাহী মসজিদ, পাগলামুড়া বাজার, চৌদ্দ মাতাল। অষ্টগ্রামে রাত যাপন করার জন্য রয়েছে ডাকবাংলো।
যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে ভৈরব এসে লঞ্চে করে অষ্টগ্রামে যাওয়া যায়। আবার বাসে কুলিয়ারচরে এসে লঞ্চে উঠে আসুন অষ্টগ্রামে। সময় লাগে ৩ ঘণ্টা।
অষ্টগ্রাম থেকে মিঠামইন, ইটনার দিকে লঞ্চ যায়। ট্রলারেও যাওয়া যাবে। অষ্টগ্রাম থেকে আজমিরিগঞ্জ লঞ্চ যায় মেঘনা নদী হয়ে। সময় লাগে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। বড় বড় নৌকাও চলে হাওরের নদীতে। বর্ষায় কূল-কিনারার দেখা মেলে না। তবে শীতে মেঘনা নদীর এপার-ওপার দেখা যায়। হেমন্তে হাওর এলাকায় বেড়াতে এসে দেখবেন কৃষকরা ধানের বীজতলা তৈরি করছে। হাওরে বছরে একবারই ধান চাষ হয়। চৈত্র-বৈশাখে এখানে ধান কাটা হয়। তখন উত্সব হয় জাঁকজমকভাবে।
সুনামগঞ্জের হাওর: সুনামগঞ্জকে বলা হয় হাওরের শহর। এই সুনামগঞ্জের সুল্লা, দিরাই, ধর্মপাশা ও তাহিরপুরে গেলে হাওরের পর হাওর দেখবেন। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জে যাবেন সড়ক পথে বাসে। রাত ১০টায় বাসে উঠলে সকাল ৬টায় গিয়ে সুনামগঞ্জে পৌঁছবেন। সুনামগঞ্জের সুরমা নদী হয়ে ট্রলার ও লঞ্চে হাওর এলাকায় যাওয়া যায়। সুনামগঞ্জে গিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে যাবেন। এই হাওরে রয়েছে সবুজ গাছগাছালি, মাছ আর কতনা প্রজাতির পাখি। জীব-বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ১০ হাজার হেক্টর আয়তনের টাঙ্গুয়ার হাওর এখন লাখ লাখ অতিথি পাখির অভয়াশ্রম।
এখানে গিয়ে দেখবেন হিজল গাছের ছড়াছড়ি। পড়ন্ত বিকেলে এখানে ঘুরতে এসে যদি সন্ধ্যা নামে তাহলে হয়তো মনে পড়বে-‘হিমের রাতে এই গগণের দ্বীপগুলিরে/হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে’কিংবা ‘আজি এল হেমন্তের দিন/কুহেলী বিলীন, ভূষণ বিহীন/বেলা আর নাই নাকি, সময় হয়েছে নাকি/দিন শেষে দ্বারে বসে পথ পানে চাই’ কবিতার এই চরণগুলো। এই টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির ফিশিং ঈগলসহ দুই শতাধিক দেশি-বিদেশি প্রজাতির পাখি, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১১২ প্রজাতির মাছ, ২১ প্রজাতির সাপ আরও কত কি!
সুনামগঞ্জ থেকে সকালে টাঙ্গুয়ার হাওরে রওনা দিয়ে যাবেন। আবার সন্ধ্যার আগে ফিরে আসুন। ধর্মপাশা থেকেও টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়া যায়। জাদুকাটা নদী, প্রাচীন লাউড় রাজ্য, খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়, আরেফিনের দরগা ও চুনা পাথরের খনি দেখতে চাইলে সুনামগঞ্জের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তাহিরপুরে যাবেন। যাওয়ার পথে দেখবেন নদী আর হাওর। সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর যাওয়ার জন্য ইঞ্জিনচালিত নৌকা রয়েছে। সময় লাগে সাড়ে ৩ ঘণ্টা। তাহিরপুর থেকে টেকেরঘাট যাওয়ার পথেও হাওর দেখবেন। সুনামগঞ্জ থেকে বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, জামালগঞ্জ যাওয়ার পথেও বিশাল বিশাল হাওর দেখবেন। বর্ষায় এসব হাওরের দৃশ্য হয় অবিকল সাগরের মতো। যাতায়াতের উপায় নৌকা আর ট্রলার। হেমন্তে হাওরের জল সরে যায়, এ সময় বেড়াতে গিয়ে মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে বেড়াতে হবে। দেখবেন গাছে গাছে কত না পাখি। তখন তো মন উত্ফুল্ল হয়ে উঠবে।
হাওরে কেমন লাগবে: হেমন্তে হাওরে বেড়াতে এসে খুব ভোরে কুয়াশা দেখবেন। এখানের অতিথি-বত্সল মানুষের আন্তরিক ব্যবহার আপনাকে মুগ্ধ করবে। সব মিলিয়ে হাওর যেন সম্পূর্ণ এক অন্য ভুবন, যার তুলনা মেলা ভার।
কত টাকা খরচ হবে: কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা দেখে লঞ্চে কিংবা ট্রলারে উঠে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় যাবেন। হাওর এলাকায় বেড়ানোর জন্য এক সপ্তাহ সময় হাতে নিয়ে যাবেন। এ ভ্রমণে জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা করে নিয়ে গেলেই চলবে।
নিকলির হাওড়ে: হেমন্তকালে নিকলিতে গিয়ে হাওড়ে নৌকায় বেড়ানো যায়। হাওড়ের অনেক জায়গা থেকে পানি সরে যেতে শুরু হয় হেমন্তে। ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে নিকলিতে সরাসরি বাস যায় এখন। ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ টাকা। সময় লাগে প্রায় ৪ ঘণ্টা। নিকলিতে গিয়ে হাওড় ছাড়াও দেখবেন পাহাড় খানের (রহ.) মাজার। মেহন্তে নৌকায় বসে বেড়ানোর পাশাপাশি হেঁটেও দূরে যাওয়া যায়। পানির দিকে চোখ যেতেই চোখে পড়বে জেলেরা নৌকায় বসে জাল ফেলছে কিংবা কাছ থেকে চলে যাওয়া নৌকা দেখে হৃদয়ে জেগে উঠবে-`ওগো, তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে? বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে। যেয়ো যেথা যেতে চাও, যারে খুশি তারে দাও-’ কবি গুরুর লেখা কবিতার এই চরণগুলো।
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]
পাঠকের মন্তব্য: