দূর্গম সীমান্তে খাগড়াছড়ি বিজিবি সেক্টরের অদম্য অগ্রযাত্রা

প্রকাশিত: ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০৪:১৯ পিএম

দূর্গম পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৬৩.৮ কি.মি. সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও অবিচল দেশপ্রেমের সাথে দায়িত্ব পালন করছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) খাগড়াছড়ি সেক্টর। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং এ অংশের অরক্ষিত সীমান্ত সুরক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৯০ সালে খাগড়াছড়ি সেক্টরের গোড়াপত্তন ঘটে।

প্রাথমিকভাবে রামগড়, যামিনীপাড়া, পলাশপুর ও পানছড়ি এই ৪ টি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে এ সেক্টর সংগঠিত হলেও পরবর্তীতে রামগড়, যামিনীপাড়া, পলাশপুর নিয়ে গুইমারা সেক্টর গঠিত হয়। বর্তমানে পানছড়ি, বাবুছড়া, বাঘাইহাট (হাজাছড়া), মারিশ্যা এবং খাগড়াছড়ি এই ৫টি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে পূর্ণগঠিত হয়ে ২০১৪ সাল থেকে বর্তমান খাগড়াছড়ি সেক্টর দায়িত্ব পালন করছে।

সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বিজিবি সেক্টরের সকল সদস্য ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা এবং দেশ প্রেমে বলিয়ান হয়ে মাতৃভূমির সীমান্ত সুরক্ষায় প্রতিনিয়ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। দূর্গম ও বিপদসংকুল পাহাড় ও জঙ্গল পরিবেষ্টিত জনমানবহীন সীমান্ত অঞ্চলে সকল প্রতিকুলতাকে উপেক্ষা করে দিনের পর দিন কাজ করে চলছে প্রতিটি বিজিবি সদস্য। এই অকুতোভয় বীর সীমান্ত রক্ষীদের পদচারনা মুখর দূর্গম সীমান্ত অঞ্চলের প্রতি ইঞ্চি ভূমি।

সীমান্ত ব্যবস্থাপনার এক অনন্য নজির সৃষ্টি হয়েছে এ প্রান্তে। দূর্গমতাকে পায়ে দলে, সেক্টর কমান্ডার থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার স্ব স্ব প্রতিপক্ষের সাথে সীমান্ত সম্মেলনসহ এ অঞ্চলে সকল প্রকার সীমান্ত ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম চলছে নিয়ম মাফিক। ঘন্টার পর ঘন্টা উঁচু-নিচু পাহাড় ও জঙ্গল অতিক্রম করেই পৌঁছাতে হয় দূর্গম সীমান্তে। এর পর সীমান্ত পিলার পরিদর্শন, প্রতিপক্ষের সাথে যৌথ টহল, শূণ্য লাইনে মার্চ এ সকল কাজ শেষে আবার পায়ে হেঁটে বিওপিতে ফেরত আসা। এ কার্যক্রম চলে প্রতিদিন, সপ্তাহ, মাস, বছর পেরিয়ে যুগ যুগ ধরে। সীমান্তরক্ষীদের পরিবারগুলো অনেক দূরে অধির আগ্রহে বসে থাকে পিতা, স্বামী, পুত্র বা আপনজনের আগমনের অপেক্ষায়। ঈদ পার্বনের মত আনন্দের অনুষ্ঠানগুলিতে গড় হাজির এ অকুতোভয় সীমান্তরক্ষীরা অন্যের আনন্দ নিশ্চিত করতে গিয়ে নিজের আনন্দ জলাঞ্জলি দেয় অকাতরে।

শুধু সীমান্ত সুরক্ষাই নয়! বিজিবি সদস্যদের শ্রম, ঘাম ও রক্তে পাহাড়-জঙ্গলে তৈরী হওয়া সরু পায়ে চলা পথ এখন পরিণত হচ্ছে বিশেষ সড়কে। এতে যান, অল টিরেইন ভেহিক্যাল চলাচল উপযোগী রাস্তায় কিংবা নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরী হচ্ছে বেতার যোগাযোগের পরিকাঠামো। গত দুই বছরে একটু একটু করে সদস্যদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় ঘামে ও শ্রমে প্রায় ২০০ কি.মি. এটিভি রাস্তা নির্মিত হয়েছে। এর মাধ্যমে বিওপি থেকে সীমান্ত এবং বিওপি থেকে বিওপিতে গমন দ্রুত ও সহজতর হয়েছে।

এ ছাড়াও জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং রোগী পরিবহনেও গতিশীলতা এসেছে। এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও পাহাড়ী খরস্রোতা ও অগভীর ছড়াগুলোকে নিজস্ব কৌশলে নৌ চলাচলের মাধ্যমে পরিণত করা হয়েছে। পুরো বর্ষা মৌসুম ধরে চলে বিশেষভাবে তৈরী নৌকা দিয়ে চলাচলের ব্যবস্থা। শুকনো মৌসুমে কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে পানি বৃদ্ধি করে এ ছড়াগুলো কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। এর ফলে সীমান্তে পৌঁছানোর পূর্বেই ক্লান্ত হয়ে পড়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

ছবি: প্রতিনিধি

এছাড়াও রেডিও রিলে স্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে দূর্গম বিওপিতে যোগাযোগ স্থাপন করার মাধ্যমে আজ এ সেক্টরের অধিকাংশ বিওপি’র বিজিবি সদস্যগণ তাদের পরিবারের সাথে যুক্ত হতে সক্ষম হয়েছে। ভবিষ্যতে এর আংগীত আরও বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যহত রয়েছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থার পালে হাওয়া লাগার সাথে সাথেই এই সেক্টরের চোরাচালান প্রতিরোধ অভিযান তরান্বিত হয়েছে। গত এক বছরে সেক্টরের অধীনস্থ ব্যাটালিয়নসমূহ চোরাচালান পন্য আটকের ক্ষেত্রেও অনন্য নজির স্থাপন করেছে। বিভিন্ন অভিযানে প্রায় ২ কোটি ৪ লক্ষ টাকার বেশী মূল্যের মাদকদ্রব্য ও চোরাচালান মালামাল জব্দ করা হয়েছে।

ছবি: প্রতিনিধি

খাগড়াছড়ি সেক্টর নিজস্ব দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় সুবিধা বঞ্চিত পাহাড়ী বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর পাশে রয়েছে সর্বদা। আর্থিক সাহায্য, চিকিৎসা সুবিধা, শিক্ষা বিস্তার, সামাজিক উন্নয়ন এবং উৎপাদিত পণ্য বিপণনে সাদ্ধাতিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বছরব্যাপী বিভিন্ন দূর্গম এলাকায় মেডিক্যাল ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয়েছে। এতে হাজার হাজার অসহায় হতদরিদ্র পরিবারের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি গৃহ নির্মাণ ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রায় ১০ লাখ টাকার নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও দুর্গম এলাকাগুলোতে প্রায় ১১ লাখ টাকার খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

দূর্গম এলাকার সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জপুই পাড়া এবং উদলছড়ি পাড়ায় দু’টি নতুন বিদ্যালয় তৈরী কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়াও খাগড়াছড়ি সেক্টরের নিজস্ব জমিতে চেঙ্গী প্রাইমারী স্কুল এবং মারিশ্যা ব্যাটালিয়নের তত্ত্বাবধানে বর্ডার গার্ড পাবলিক স্কুল, বর্ডার গার্ড প্রাইমারী স্কুল এবং সাজেক প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ অত্যন্ত সুনামের সাথে পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে উঁচুমানের শিক্ষা প্রদান কার্যক্রম পরিচালনা করে চলছে।

এ অঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত পাহাড়ী বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর খেলাধুলার মানোন্নয়ন এবং মেধা বিকাশের লক্ষে খাগড়াছড়ি সেক্টর বিভিন্ন পর্যায়ে খেলাধুলার আয়োজন করে থাকে। এছাড়াও বঞ্চিত জনসাধারণের মধ্যে খেলাধুলার সামগ্রীও বিতরণ করা হচ্ছে নিয়মিত। সম্প্রতি নিউথাংনাং পাড়ায় সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২৪০০ ফুট উচ্চতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে সীমান্ত কাপ ফুটবল প্রতিযোগীতা। এত দূর্গম স্থানে টুর্নামেন্ট আয়োজনের মধ্যে সেক্টর এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে। এর মাধ্যমে উৎসাহিত পাহাড়ী জনগোষ্ঠী সাম্যের ধারায় সিক্ত হয়ে উৎকর্ষতার দিকে ধাবিত হবে।

দূর্গম এ অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করার এক সুবিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাকে পাথেয় করে এক ইঞ্চি জমিও ফেলে না রেখে তাতে কৃষি পন্য উৎপাদন এবং সুবিধাজনক স্থানে গবাদী পশু পালনে দূর্গম এলাকার জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করার কার্যক্রম চলছে। বিজিবি’র নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিজস্ব আর্থিক সাহায্যে কৃষি উপকরণ কিনে দেওয়া, গবাদী পশু কিনে দেওয়া, পানির জন্য সোলার/ডিজেল পাম্প স্থাপন করে দেওয়া হচ্ছে।

এর মাধ্যমে উৎপাদিত কৃষি পন্য ও গবাদী পশু দুর্গম বিওপি সমূহের খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে সরকারের মূল্যবান অর্থ সাশ্রয় করবে এবং সেই সাথে উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিপণনের সুবিধা তৈরী হবে পাহাড়ী জনগনের জন্য। পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতি বিকাশে কাজ করছে খাগড়াছড়ি সেক্টর। বাদ্যযন্ত্র প্রদান, পাহাড়ী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজনের মাধ্যমে সেক্টরের অধীনস্থ ব্যাটালিয়নসমূহ কাজ করে যাচ্ছে। শুদ্ধ সাংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে যুবক শ্রেনীকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছে এবং এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটছে।

খাগড়াছড়ি বিজিবি সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'অত্যন্ত দক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও অবিচল দেশপ্রেমের সাথে দায়িত্ব পালন করছে খাগড়াছড়ি বিজিবি সেক্টর। প্রতিটি বিজিবি সদস্য দুর্গম সীমান্ত এলাকা গুলোতে নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে দেশের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। পাশাপাশি পাহাড়ের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলোর প্রতি সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। নিয়মিত অবৈধ চোরাচালান এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধে খাগড়াছড়ি বিজিবি সর্বদা সোচ্চার রয়েছে। এ লক্ষ্যে আমরা দিন রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। আমাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।' স্থানীয় সকল স্তরের জনগন ও অন্যান্য সংস্থার নিকট চোরাচালান রোধে সর্বাত্মক সহযোগীতা কামনা করেন তিনি।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ খাগড়াছড়ি সেক্টর সদর দপ্তরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন (বিজিবিএম, পিবিজিএম) বলেন, 'বিজিবি খাগড়াছড়ি সেক্টর অত্যন্ত দক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও অবিচল দেশপ্রেমের সাথে দায়িত্ব পালন করছে। প্রতিটি বিজিবি সদস্য দূর্গম সীমান্ত এলাকাগুলোতে নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে দেশের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। পাশাপাশি পাহাড়ের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলোর প্রতি সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। নিয়মিত অবৈধ চোরাচালান এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধে বিজিবি, খাগড়াছড়ি সেক্টর সর্বদা সোচ্চার রয়েছে। এ লক্ষ্যে আমরা দিন রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি।তিনি স্থানীয় সকল স্তরের জনগণ ও অন্যান্য সংস্থার নিকট চোরাচালান রোধে সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করেন।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: