চুয়াডাঙ্গায় ঘটে ইতিহাসের ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা: নিহত ৫ শতাধিক

‘কারো হাত নেই, কারো পা নেই, কারো মাজা থেকে দেহ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, কারো শরীরে রড ঢুকে গেছে, কেউ পানি পান করে বাঁচার জন্য আকুতি করছে- মুখে পানি দিতেই তারা মারা যাচ্ছেন। কারো পা আটকে আছে উল্টে যাওয়া ট্রেনের বগির নিচে, সেটা বের করার জন্য তার পা কেটে বের করতে হচ্ছে। চোখের সামনে শুধু লাশ আর লাশ! রক্তে ভেসে গেছে পুরো এলাকা! দুর্ঘটনার বেশ কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও, সেসব কথা মনে হলে এখনো গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। ঘুমের ঘোরেও মাঝে মধ্যে আতকে উঠি’। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া চুয়াডাঙ্গার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সেই ঘটনার এভাবেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন গাইদঘাট গ্রামের কিছু বৃদ্ধ মানুষ।
প্রত্যক্ষদর্শী গাইদঘাট গ্রামের গোলাম রসুল বলেন, ‘ঐ দিন দুপুরে আমরা তিন বন্ধু ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। রেললাইনের একটু দূরেই আমাদের বাড়ি। কোরের মাঠ থেকে বিকট আওয়াজ শুনে দৌড়ে গেলাম দেখতে। এসে দেখি দুর্ঘটনার ভয়াবহতা। ট্রেনের আহত যাত্রীরা যে যেমন পারছে ছুটাছুটি করছে। পুরো এলাকা ধুলোই অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। আমরা তিন বন্ধু বাড়ি থেকে কলসে করে পানি নিয়ে আসলাম তাদের সাহায্য করার জন্য। আশে পাশের লোকজন সব এগিয়ে আসল উদ্ধার করার জন্য। ট্রেনের ইঞ্জিন ছিটকে পড়েছে পাশের মাঠের মধ্যে। ট্রেনের বগি উঠে গেছে একটার উপরে আর একটা। বগির ভিতরে বীভৎস লাশ আর লাশ! আমরা তখন রেডিওর খবরে শুনতে পাই ৭৪ জন নিহত হয়েছেন। কিন্তু আমাদের হিসাবে পাঁচশতাধিক মানুষ সেই সময় নিহত হয়েছেন’।
একই গ্রামের মোহাম্মদ আলমগীর কবির বলেন, ‘দুর্ঘটনার সময় আমি খুব ছোট ছিলাম, তখন আমার মাত্র ১২ বছর বয়স ছিল। তবু সেই কথা পরিষ্কার মনে পড়ে। দুর্ঘটনার কথা শুনে দৌড়ে গেলাম কোরের মাঠে। যেয়ে দেখি আহত যাত্রীদের বাঁচার আর্তনাদ। চোখের সামনে শত শত লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। আহত যাত্রীদের কারও হাত আটকে আছে বগির মধ্যে হাত কেটে বের করতে হয়েছে। যার পা আটকে আছে তার পা কেটে বের করছে। কারো শরীরে রড ঢুকে আছে। রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। যে যেভাবে পেরেছে আহতদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছে। গ্রামের সবাই সে সময় প্রশাসনের সাথে উদ্ধার কাজে যোগ দেয়। শত শত আহত মানুষের বাঁচার আকুতি দেখেছি নিজের চোখে সেই কথা এখনো মনে হলে এখনো আতকে উঠি’।
ঐ গ্রামের সিদ্দিকুল হাসান খোকন বলেন, ‘দুর্ঘটনার দিন আমি দর্শনার শ্যামপুর গ্রামে ছিলাম। রাইটা নামে একটি ট্রেনে ফেরার পথে দুর্ঘটনার স্থানে আমাদের ট্রেনটি থামে। ট্রেন থেকে নেমে দেখি দুর্ঘটনার ভয়াবহতা। শত শত লাশ সারি বদ্ধভাবে সাজানো দেখে ভয় পেয়ে যায়। ভয়ে আমি আর ঐ স্থানে দাঁড়াতে পারিনি। আমি বাড়ি চলে এসে স্তব্ধ হয়ে যায়’।
গাইদঘাট গ্রামের ইদু মন্ডল, আব্দুল খালেক, পাশের জয়রামপুর গ্রামের সামসুল হকসহ আরও অনেক মানুষ ছিলেন সে সময়ের ভয়াবহতার প্রত্যক্ষদর্শী। সেদিনের দুর্ঘটনার ভয়াবহতা এখনো চোখে ভাসে তাদের। তারা যখন নিজের মুখে সে দুর্ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিল তখন তা শুনে বোঝা যাচ্ছিল এ দুর্ঘটনার ভয়াবহতা কতটা তীব্র। তাদের চোখে মুখে এখনো আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গাইদঘাট গ্রামটি চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৯৭৯ সালের ২৬ জানুয়ারি এ গ্রামের কোরের মাঠ নামক স্থানে ঘটে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা। ওইদিন বেলা ১টা ২০ মিনিটে খুলনা থেকে পার্বতীপুরগামী রকেট মেইল ট্রেনটি চুয়াডাঙ্গার গাইদঘাটের কোরের মাঠে পৌঁছুলে দুর্ঘটনা কবলিত হয়। যা ইতিহাসের ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা। শেষের বগিটা ছাড়া সব বগিই পড়ে গিয়েছিল। একটা বগি উঠে গিয়েছিলো অন্য বগির উপর। সরকারি হিসাবে এ দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিলো ৭৪ জন এবং বেসরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা ৫ শতাধিক। এ দুর্ঘটনায় আরও আহত হয়েছিলো অন্তত কয়েকশ যাত্রী।
বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, এই দুর্ঘটনার আগেও ১৯৪০ সালে একই স্থানে ট্রেন দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকজন মানুষ মারা যায়। ১৯৭৯ সালের ৩০ অক্টোবর একই স্থানে ঘটে আরেকটি ট্রেন দুর্ঘটনা। ১৯৮০ সালের ১০ আগস্ট আবারো এখানে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যায় ৪ জন।
ঘটনার দীর্ঘ ৪৪ বছর পরও ওই পথটি ঝুঁকিমুক্ত হয়নি। এই স্থানের ৩ কিলোমিটার রেললাইন রয়েছে এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
গাইদঘাট গ্রামের ওপর দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-খুলনা, রাজশাহী-খুলনা, পার্বতীপুর-খুলনা ও ঢাকা-কোলকাতা রেললাইন। এ রেলপথে ঢাকা-কোলকাতা মৈত্রী ট্রেনসহ বেশ কয়েকটি যাত্রীবাহি ট্রেন ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করে। এই রেললাইনটি দেখতে অনেকটা ধনুকের মতো বাঁকা এবং রেললাইনের দুই পাশে নিচু জমি। রেলপথটি এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ আমলের পর থেকে এ স্থানে বড় ধরনের সংস্কার করা হয়নি। ফলে সবসময়ই ঝুঁকির মধ্যে থেকেছে চুয়াডাঙ্গা জেলার গাইদঘাট এলাকার রেলপথ।
চুয়াডাঙ্গা ইতিহাস পরিষদের পরিচালক অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সী বলেন, ‘১৯৭৯ সালের ২৬ জানুয়ারি গাইদঘাটে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর ১৯৮১ সালে এখানে গাইদঘাট রেলওয়ে স্টেশন ও ট্রেন দুর্ঘটনার স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এর এ স্টেশনকে কেন্দ্র করে এখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও হাট বাজার গড়ে উঠে। কয়েক বছর পরই স্টেশনটি বন্ধ ঘোষণা করে রেল কর্তৃপক্ষ। গাইদঘাট স্টেশনের টিনশেড ভবনটি এখন অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে এবং দুর্ঘটনার স্থানের স্মৃতিসৌধটির পলেস্টারা উঠে গেছে এবং ফাটল ধরে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। গাইদঘাট রেলস্টেশনের পাশে যে রেলগেটটি আছে তা এখনো অরক্ষিত রেলক্রসিং হিসেবে আছে। যার ফলে এ এলাকাটি এখনো দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে আছে। মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই নিজ দায়িত্বে পারাপার হতে হয় ব্যস্ততম এই রেলক্রসিং’।
চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মিজানুর রহমান বলেন, ‘ ১৯৭৯ সালের ২৬ জানুয়ারি দুপুরে জয়রামপুর এবং চুয়াডাঙ্গার মাঝামাঝি গাইদঘাট নামক স্থানে আপ রকেট মেইল ট্রেনটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। আমি জেনেছি সে সময় বহু মানুষ নিহত এবং আহত হয়’।
এলাকাবাসীর দাবি, এই এলাকায় একাধীকবার বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটার পরও ব্যস্ততম গাইদঘাট রেলক্রসিংটি দীর্ঘ সময় ধরে অরক্ষিত থাকা মেনে নেওয়ার মতো না। এলাকাবাসী ও পথচারীদের নিরাপত্তায় অবিলম্বে রেলগেট স্থাপন করা জরুরী। একই সাথে যত দ্রুত সম্ভব এ এলাকার রেলপথে যে ক্রটিগুলো আছে তা চিহ্নিত করে এবং অরক্ষিত রেলক্রসিংটিতে গেট স্থাপন করে ঝুঁকিমুক্ত করতে হবে।
শাকিল/সাএ
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]

পাঠকের মন্তব্য: