যে ‘দুই কারণে’ শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি, আটক ৪

প্রকাশিত: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৭:৫০ পিএম

নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ খানকে বাড়িতে ঢুকে গুলি করার পেছনে দুটি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। এর একটি-দলীয় কোন্দলে দ্বিধাবিভক্ত স্থানীয় রাজনীতির একপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হারুনুরকে সরিয়ে দিতে অন্য পক্ষ এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। আরেকটি হলো-জেলার সবচেয়ে বড় গরুর হাট পুটিয়া বাজারের ইজারা পাওয়াকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব। দুটি বিষয় পরস্পর সম্পর্কিত বলে ধারণা করছেন নেতা-কর্মীরা।

এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এবং শিবপুর থানার পুলিশ নরসিংদী ও শিবপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেফতার করে।

জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক চারজন হলেন শিবপুরের পুটিয়া ইউনিয়নের কামারগাঁও এলাকার মৃত হাফিজ উদ্দিনের ছেলে ফরিদ সরকার (৬৩) ও সিরাজ মোল্লার ছেলে মোমেন মোল্লা (৫৯) এবং সৈয়দনগর এলাকার রোকন উদ্দিনের ছেলে সাব্বির মিয়া (৩২) ও আয়েছ আলীর ছেলে মনসুর আহমেদ রানা (৪৩)।

গত শনিবার সকাল সোয়া ছয়টার দিকে শিবপুর পৌর এলাকার বাজার সড়কে নিজের বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হন হারুনুর রশিদ খান। বর্তমানে তিনি রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। গতকাল এই হাসপাতালে নেওয়া হলে তাঁর পিঠে বিদ্ধ দুটি গুলি বের করা হয়। এখন তিনি ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে আছেন।

হারুনুর রশিদ খান শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। তাঁর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিবপুর থানার ১০০ গজের ভেতরে বাজার এলাকায় হারুনের পাঁচতলা বাড়ি। বাড়িটির নিচতলায় দোকানপাট, দ্বিতীয় তলায় বেসরকারি একটি ব্যাংকের শাখা ও তৃতীয় তলায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকেন তিনি। তাঁকে গুলি করার সময় বাড়িতে ছিলেন তাঁর স্ত্রী বেবি খানম, ছেলে আমিনুর রশিদ খান, বোন মরিয়ম খানম ও তাঁর স্বামী শাজাহান খান।

হারুনুর রশিদ খানের পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, প্রতিদিনই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত অনেক মানুষ হারুনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। গতকাল সকালে বাইরে হাঁটতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। এর মধ্যে একজন তাঁর মুঠোফোনে তিন থেকে চারবার কল দেন, দেখা করতে চান। আসতে বলা হলে তিনজন ব্যক্তি বাড়িটির তৃতীয় তলায় এসে কলবেল চাপেন। তিনি নিজেই দরজা খুলে দেন, তাঁদের ভেতরে এসে বসতে বলেন। তাঁরা তিনজনই সোফায় এসে বসার পর আপ্যায়নের জন্য তিনি নিজে পেয়ারা কেটে আনেন। তাঁদের সামনে পেয়ারা রাখার পরপরই একজন তাঁর দিকে পিস্তল তাক করেন। এ সময় ঘুরে নিরাপদ স্থানে যেতে উদ্যত হলে পরপর দুটি গুলি তাঁর পিঠে লাগে।

হারুনুর রশিদ খান গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই তাঁর সঙ্গে আছেন ভাতিজা ফজলে রাব্বি খান। তিনি মনে করেন, দুর্বৃত্তরা হারুনুর রশিদের বুকে গুলি করার টার্গেট নিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি ঘুরে যাওয়ায় পরপর দুটি গুলি তাঁর পিঠে লাগে। জড়িত ব্যক্তিরা পেশাদার শুটার। স্থানীয় কারও প্রশ্রয় ছাড়া এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। যাঁরা তাঁর চাচাকে গুলি করেছেন, তাঁদের তিনজনকেই চিনতে পেরেছেন বলে চাচা হারুনুর রশিদ খান বলেছেন। তিনি পুলিশের কাছে তিনজনের সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের একাংশের নেতা-কর্মীরা বলছেন, শিবপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে স্পষ্ট দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে আছেন নেতা-কর্মীরা। একপক্ষে আছেন বর্তমান সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভূঁইয়া, অন্য পক্ষে সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা। দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকায় তৃণমূলের রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতা ও প্রভাব বেশি হারুনুর রশিদ খানের। এ জন্য দুই পক্ষই তাঁকে নিজেদের সঙ্গে রাখতে চায়। হারুন একেক সময় একেক পক্ষের সঙ্গে সক্রিয় থেকে রাজনীতি করছেন।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে পরাজিত করে বিজয়ী হওয়া জহিরুল হক ভূঁইয়ার সঙ্গে ছিলেন হারুন। পরবর্তী সময়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে তিনি সিরাজুল ইসলাম মোল্লার সঙ্গে যান। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম মোল্লা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে তাঁর সঙ্গেও দ্বন্দ্ব দেখা দিলে তিনি আবার যুক্ত হন জহিরুলের সঙ্গে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হন। তাঁর সঙ্গে আবারও দ্বন্দ্ব হওয়ায় এখন তিনি সিরাজুল ইসলাম মোল্লার সঙ্গে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন।

অন্যদিকে জেলার সবচেয়ে বড় গরুর হাট পুটিয়া বাজারের ইজারা গত বছর যৌথভাবে পেয়েছিলেন খোরশেদ হাজী ও আরিফ সরকার নামের দুজন। উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন এ বছর আরিফ সরকারকে বাদ দিয়ে খোরশেদ হাজীকে ওই হাটের ইজারা দেন। তিন কোটি টাকার বেশি ডাক ওঠা এই হাটের ইজারা না পাওয়ায় আরিফ তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। আরিফই ওই তিনজনকে হারুনের কাছে পাঠিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের ভাষ্য, আরিফ সরকার সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠজন। গত শুক্রবার রাতে তিনি দেশ ছেড়েছেন।

এ বিষয়ে সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভূঁইয়া বলেন, হারুনুর রশিদ খানের ওপর যাঁরা গুলি চালিয়েছেন, তাঁরা সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসীদের অন্য কোনো পরিচয় থাকতে পারে না। তিনি জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।

সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা জানান, হারুনকে মেরে ফেলার জন্য এই হামলা করা হয়েছে। হারুনুর নিজেই বলেছেন যে আরিফ তাঁকে মেরে ফেলতে ওই তিনজনকে পাঠিয়েছিলেন। জহিরুল হক ভূঁইয়া আবারও সংসদ সদস্য হতে চান, হারুন সঙ্গে না থাকলে নির্বাচিত হতে পারবেন না; তাই পথের কাঁটা দূর করতে আরিফকে দিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছেন।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: