কক্সবাজারে ‘টাকায় মিলে’ ছাত্রলীগের পদ

প্রকাশিত: ০২ এপ্রিল ২০২৩, ১২:১১ এএম

তিনটি উপজেলা, একটি ইউনিয়ন ও একটি কলেজ ছাত্রলীগ কমিটির অনুমোদন দিয়েছে কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ। শুক্রবার (৩১ মার্চ) মধ্যরাতে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। অনুমোদিত কমিটির তালিকা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে জেলাজুড়ে। কমিটিতে বিতর্কিতদের স্থান দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মীরা।

অভিযোগ উঠেছে, ছাত্রলীগের পদে আসতে এমনকি কেউ কেউ জমিজমা ও বসতঘর বন্ধক রেখে লাখ লাখ টাকা দিয়েছেন। নির্ধারিত টাকা একসাথে দিতে না পারলে বাকী টাকা পরিশোধে আবার কেউ কেউ দিয়েছেন ব্যাংকের চেকও। এইসব কমিটি ঘিরে যেন টাকা ইনকামের মহোৎসবে মেতেছেন জেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ এই দুই নেতা। এমন অভিযোগ সাধারণ ছাত্রলীগ কর্মীদের।

এসব কমিটিতে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মামলার আসামী, বিবাহিত, ব্যাবসায়ী, চাকুরীজীবি, প্রবাসী, অছাত্র, নারী কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত, ও বিএনপি-জামায়াত নেতার ছেলে স্থান পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন খোদ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাদের দাবী ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।

জানা গেছে, কুতুবদিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটির আহ্বায়ক মহিদুল হাসান হান্নানের ছাত্রলীগ করার নির্ধারিত বয়স পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। অতিথেও ছাত্রলীগের কোন কমিটিতে ছিলেন না। তার বর্তমান বয়স ৩৫। বিয়েও করেছেন ৫ বছর আগে। এক কন্যা সন্তানও রয়েছে। নেই ছাত্রত্ব। এছাড়াও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এরশাদুল হাবীব রুবেল হত্যা মামামলার এজাহার ভূক্ত আসামী তিনি। কমিটির যুগ্ন আহবায়ক তারেক আজিজ কুতুবীরও ছাত্রলীগ করার নির্ধারিত বয়স পেরিয়ে গেছে। আট বছর ধরে নেই ছাত্রত্ব। হত্যা চেষ্টা মামলার চার্জশিটভূক্ত আসামী তিনি। কমিটির সদস্য ওপেল শরীফের পিতা কুতুবদিয়া উপজেলা বিএনপির অর্থ সম্পাদক। এছাড়াও সদ্যঘোষিত কমিটির অনেকেরই ছাত্রত্ব না থাকা ও বয়স সীমা পেরিয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রলীগের পদ বঞ্চিত নেতাকর্মীরা।

টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগনেতা হত্যা মামলার আসামী, বিবাহিত, অছাত্র ও ছাত্রলীগ করার নির্ধারিত বয়স সীমা পেরিয়ে যাওয়াদের নিয়ে নবঘোষিত কমিটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে পারিবারিক সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে পদত্যাগ করেছেন খোদ ওই কমিটির একজন যুগ্ন-আহবায়ক। তার দাবী, কমিটিতে যোগ্য অনেকের জায়গা হয়নি। রহস্যজনক কারণে জায়গা হয়েছে মামলার আসামী, বিবাহিত ও অছাত্রদের। ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।

মহেশখালী উপজেলা ছাত্রলীগ কমিটির আহ্বায়ক জসিম উদ্দীন বিজয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কাছে অপরিচিত মুখ। তিনি একজন ব্যাবসায়ী। স্থানীয় রাজনীতিতে তার কোন ভূমিকা না থাকলেও জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনানের বিশ্বস্ত ব্যবসায়িক পার্টনার হওয়ায় তাকে বানানো হয়েছে আহ্বায়ক। ২০ লক্ষ টাকা নিয়ে তাকে আহ্বায়ক বানানো হয়েছে বলে দাবী খোদ ওই কমিটির এক যুগ্ন-আহ্বায়কের। কমিটির যুগ্ন আহ্বায়ক মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম একজন ঠিকাদার। সাদ্দামের কাছ থেকে ব্যবসায়িক সূতারে টাকা পায় সে ৩০ লাখের বেশি। তাকে এতোদিন সভাপতি বানানো হবে বলে অপেক্ষায় রাখলেও তাকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে টাকাগুলো হালাল করা হয়েছে বলে দাবী সাদ্দামের এক ঘনিষ্ঠের। কমিটির সদস্য আমজাদুল আলম হারুণ একজন প্রবাসি। এছাড়াও কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক মুজিবুল হাসান ও আব্দুল্লাহ আল কাইয়ুমের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

উখিয়া উপজেলা ছাত্রলীগ কমিটির আহ্বায়ক তারেক হোছেন মানিকের ছাত্রলীগ করার বয়স সীমা পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। বিয়েও করেছেন চার বছর আগে। তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ। যুগ্ম আহ্বায়ক সাইদুল আমিন টিপু ও আহবায়ক মানিক জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দামের ব্যবসা দেখাশুনা করে। তাদের কাছ থেকে কমিটি দেয়ার কথা বলে অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যুগ্ন-আহ্বয়াক আলমগীর হোসেনকে সভাপতি সাদ্দামের এটিএম কার্ড হিসেবে অনেকেই চিনেন। কক্সবাজার শহরে কেন্দ্রীয় নেতাদের আতিথেয়তার সব খরচ এটিএম কার্ড আলমগীরকে দিয়ে করা হতো বলে জানান জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উখিয়ার এক জনপ্রতিনিধি জানান, আলমগীরের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে ৩০ লাখ টাকার বেশি।

সাদ্দামের শরীর ম্যাসাজ করে মুবিন নামের এক ছেলে তাকেও বানানো হয়েছে যুগ্ম আহ্বায়ক। মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ও আলমগীর আলম নিশা দুজনেই সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনানের রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রীক ব্যবসা দেখাশুনা করেন তাই তাদেরকেও যুগ্ম-আহবায়ক করা হয়েছে বলে জানা গেছে। মূলত সভাপতি সাদ্দাম ও সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনানের রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রীক ঠিকাদারি ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই জেলার এই কমিটি বাণিজ্য বলে অভিযোগ করেছেন নেতাকর্মীরা।

এছাড়াও গঠনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে পালংখালী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের কমিটির অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কমিটিতে টাকার বিনিময়ে অছাত্র ও ইয়াবা সংশ্লিষ্টদের পদ দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে।

যদিও ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের গঠনতন্ত্রের ৫ এর 'ক' উপধারায় বলা হয়েছে, অনূর্ধ্ব ২৯ বছর বয়সী বাংলাদেশের যেকোনো স্বীকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্য হতে পারবেন। ৫ এর 'গ' উপধারা ও ৫ এর 'ক' উপধারা অনুযায়ী বিবাহিত, ব্যবসায়ী ও চাকরিতে নিয়োজিত কোনো শিক্ষার্থী ছাত্রলীগে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না। এছাড়াও ফৌজদারী মামলার আসামী ছাত্রলীগের পদে আসতে পারবে না বলে জানা গেছে। কিন্তু এসব কমিটিতে গঠনতন্ত্রের কোনো নিয়ম মানা হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছেন খোদ জেলা ছাত্রলীগের নেতারাই।

এ বিষয়ে উখিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা বলেন, উখিয়া থানা ছাত্রলীগের কমিটিতে যাদের নেতা বানানো হয়েছে, তাদের কারও কাছ থেকে ১০ লাখ টাকার কম নেওয়া হয়নি। তবে অনেকের কাছ থেকে এর দ্বিগুণ টাকাও নেওয়া হয়েছে। টাকার বিনিময়ে হোটেল বয়, নানা বির্তকিতদের পদায়ন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষকেই বাদ দেওয়া হয়নি মধ্যরাতের এই কমিটিগুলোতে। ছাত্রলীগের সর্বনিম্ন পর্যায়ের ওয়ার্ড কমিটির নেতা হওয়ার যোগ্যতা নেই এমন ব্যাক্তিকেও দেওয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পদ। বিবাহিত, অছাত্র, প্রবাসী, ব্যাবসায়ী, মাদক সংশ্লিষ্টতা, হত্যা ও হত্যা চেষ্টা মামলার আসামিরা কমিটিতে পদ পেয়েছেন, যা খুবই দুঃখজনক। এসব বিকর্কিত কমিটির মাধ্যমে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি পুরনো ছাত্র সংগঠনের ঐতিহ্যকে ম্লান করে দেওয়া হয়েছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই কমিটি বাণিজ্যের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানিয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের এই নেতা।

মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সিনিয়র নেতা বলেন, জন্মের পর থেকে পারিবারিক সূত্রে আওয়ামী লীগ করি। কখনো দেখিনি এভাবে তৃণমূল ছাত্রলীগ নেতাতের কাছ থেকে নানা ভাবে জেলার নেতারা টাকা হাতিয়ে নেয়। ছেলেদের ছাত্রলীগ নেতা বানাতে কয়েকটি পরিবার একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে বলেও জানান তিনি।

উখিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা বলেন, জীবনে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও কলেজ ছাত্রলীগ করে নাই এমন অনেককেই বানানো হয়েছে যুগ্ম- আহবায়ক। বাদ যায়নি চাকুরীজীবি, ব্যাবসায়ী, বিবাহিত, অছাত্র ও মাদক সংশ্লিষ্টরাও। জীবনে যারা রাজনীতি করেনি তাদের নামও এসেছে এই কমিটিতে।

জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কমিটি-বাণিজ্য করছেন, এমন অভিযোগ পেয়েছি। এ বিষয়ে কেন্দ্রের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও কথা বলেছি। সাদ্দাম কেন্দ্রিয় আ.লীগের শীর্ষ এক নেতার আস্তাভাজন পরিচয় দিয়ে (তাঁর নাম বিক্রি করে) এইসব বাণিজ্য করে যাচ্ছেন। একারণে তাকে থামানোর মতো সাহস কারো হচ্ছেনা।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আবার যদি দলের দুর্দিন আসে, তাহলে এই ছাত্রলীগ দিয়ে কী হবে? এদের দিয়ে তো আন্দোলন-সংগ্রাম সম্ভব হবে না। এ জন্য যারা দায়িত্বশীল তাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে ধীরে ধীরে সংগঠনটি শেষ হয়ে যাবে।

সাদ্দাম-মারুফের কমিটি বানিজ্য নিয়ে ক্ষুদ্ধ আওয়ামী লীগও। কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার এই পদ বাণিজ্যের অভিযোগ সম্পর্কে অভিহিত বিভিন্ন ইউনিটের আওয়ামী লীগ নেতারাও। এদের অনেকে কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও কেউ পরিচয় দিয়ে এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মারুফ আদনানের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।এরপর ককসবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম সাদ্দাম হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে দুইজনের মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোন উত্তর দেননি তারা।

জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান জানান, মামলার আসামী, বিবাহিত, ব্যাবসায়ী, প্রবাসী ও অছাত্রদের ছাত্রলীগের কমিটিতে রাখার কোন সুযোগ নেই। যদি এমনটি হয়ে থাকে অভিযোগের বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে তদন্তপূর্বক ব্যাবস্থা নেওয়া হবে জানান তিনি।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: