অবশেষে চালু হচ্ছে সৈয়দপুর রেলওয়ে সেতু কারখানা

প্রকাশিত: ২৬ মে ২০২৩, ০৪:১২ পিএম

জনবল সংকটে টানা পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পর আবারো চালু হয়েছে নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত দেশের একমাত্র রেলওয়ে ব্রিজ ওয়ার্কশপ বা সেতু কারখানা। সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ১১ জন খালাসি আর অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া চারজন দক্ষ জনবল দিয়েই শুরু হয়েছে কারখানার উৎপাদন। পাশাপাশি চলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজও।

পুরোদমে কারখানাটিতে কর্মচাঞ্চল্য ফেরাতে দ্রুত শূন্যপদ গুলোতে আরও জনবল নিয়োগ দেওয়ার দাবি অবসরে যাওয়া কর্মচারী ও স্থানীয়দের। কর্তৃপক্ষ বলছেন, শিগগিরই আরও জনবল নিয়োগ দিয়ে পুরোদমে চালু করা হবে কারখানাটি। দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে ঘুরবে উৎপাদনের চাকাও।

ব্রিটিশ আমলের প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনা সৈয়দপুর রেলওয়ে সেতু কারখানাটি জনবল সংকটে ২০১৪ সালে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০১৮ সালে কারখানাটির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করায় দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিক-কর্মচারীদের পদচারণা না থাকায় পুরো এলাকা ছেয়ে যায় আগাছায়। খোলা আকাশের নিচে হাজার কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি পরিত্যক্ত অবস্থায় নষ্ট হচ্ছিল।

এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে নড়েচড়ে বসে রেলওয়ে কতৃপক্ষ। কারখানাটি পুনরায় সচল করতে চলতি মাসের ২ তারিখে নিয়োগ দেওয়া হয় ১১ জন খালাসি। তাদেরকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলার পাশাপাশি উৎপাদনের মান বজায় রাখতে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয় অবসরে যাওয়া চারজন দক্ষ শ্রমিককে।

দেখা গেছে, কারখানার প্ল্যাটফর্ম শেডের ভেতরে আবর্জনার স্তূপ পরিষ্কার ও পরিপূর্ণ জঙ্গলে ঢাকা কারখানাটির জঙ্গল কর্তনে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন শ্রমিকরা। এছাড়াও নিথর পরে থাকা মেশিনগুলোর প্রাণ ফেরাতে চলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজও। কারখানাটির প্রায় পাঁচ শতাধিক স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মচারীর স্থলে মাত্র ১৫ জন শ্রমিক দিয়েই আপাতত তৈরি করা হচ্ছে সিসি ক্রাপট। যা দুর্যোগকালীন সময়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে বিকল্প ব্রিজ নির্মাণে ব্যবহার করা হবে। রেলের সেবার মান বাড়াতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে উঠতে চান সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকরা।

শ্রমিক জগদিশ চন্দ্র সরকার বলেন, এই কারখানায় এ মাসের দুই তারিখ থেকে যোগদান করেছি। অভিজ্ঞ চারজন শ্রমিক আমাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। ওয়েল্ডিং-ডিজাইনের কাজে যারা সিনিয়র ছিল তারা আমাদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন এবং এ ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করছেন। আমার জানা মতে এ কারখানাটি অনেক দিন বন্ধ ছিল। এ কারণে আগাছায় ঢেকে গেছে পুরো এলাকা। এখন আমরা সবাই মিলে এই জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করছি। আমরা দক্ষ হয়ে রেল ও দেশের সেবা করতে চাই।

রাকিবুল নামে আরেক শ্রমিক বলেন, আমার সঙ্গে আরও ১০ জন খালাসি এই কারখানায় যোগদান করেছেন। সঙ্গে আরও দক্ষ চারজনকে আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা ভালোভাবে কাজ শেখাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে আমরা সিসি ক্রাপট তৈরি করেছি। বর্ষাকালীন অথবা যেকোনো সংকটকালীন সময়ে ব্রিজ ভেঙে গেলে ট্রেনকে সচল রাখার জন্য এগুলো দিয়ে অস্থায়ী ব্রিজ তৈরি করা যায়।

২০১৮ সাল থেকে সেতু কারখানাটি বন্ধ থাকার পর আবারো চালু হওয়ায় সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অবসরে যাওয়া শ্রমিকরা। তবে কারখানাটির কর্মচাঞ্চল্য আর প্রাণ ফেরাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়োগ দেওয়ার দাবি অবসরে যাওয়া শ্রমিকদের।

এখানে অনেকগুলো আইটেম তৈরি করা হতো। বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে বড় ব্রিজ হার্ডিজ ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণ করা, রেলস্টেশনে প্ল্যাটফর্ম, ওভার ব্রিজ, ওয়াটার ট্যাংকসহ বিভিন্ন আইটেমগুলো বিশেষ করে ক্রসিং আইটেমগুলো তৈরি করা হতো। ২০১৮ সালের পরে পর্যায়ক্রমে এটি বন্ধ হয়ে যায়।

এটি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের ফলশ্রুতিতে আমরা ১১ জন খালাসি ও অবসরে যাওয়া ৪ জন দক্ষ কর্মচারী পুনরায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যাদের মাধ্যমে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে।

রেলওয়ে সেতু কারখানার সহকারী প্রকৌশলী তহিদুল ইসলাম জানান, লোকবলের অভাবে কারখানাটি ২০১৮ সালে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কারখানাটি দেখভালের জন্য তিনজন লোক ছিল। সম্প্রতি ১১জন খালসি আমরা পেয়েছি। তাদেরকে দক্ষ কারিগর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অবসরে যাওয়া চারজন শ্রমিককে আহ্বান জানালে তারা সাড়া দেন। নতুনদের নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি পাশাপাশি কারখানাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের কাজ চলছে। কারখানার মেশিনগুলো চালানোর জন্য যে ধরনের লোকবল প্রয়োজন সে ধরনের লোকবল পাওয়া যায়নি। যদি আমরা লোকবলগুলো পেয়ে যাই অচিরে কারখানার মেশিনগুলো চালু করা সম্ভব হবে।

প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ আমলে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ তিন দেশের রেল নেটওয়ার্ক ছিল একই। রেল ব্যবস্থাকে স্বনির্ভর করতে ও রেলসেবা নির্বিঘ্ন করতে গড়ে তোলা হয় বিশাল এই রেল সেতু কারখানা। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়েকে ঘিরে ১৮৭০ সালে ১১০ একর জমিতে স্থাপন করা হয় সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। একই সময়ে উপমহাদেশের অন্যতম এ বৃহৎ কারখানাটির অভ্যন্তরে উত্তর-পশ্চিমাংশে প্রায় ১৮ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয় ব্রিজ ওয়ার্কশপ তথা সেতু কারখানাটি।

মূলত ব্রডগেজ, মিটারগেজ, রেলপথের ব্রিজ এবং রেলপথের পয়েন্টস অ্যান্ড ক্রসিং ও গার্ডার ইয়ার্ড তৈরির জন্যই এ সেতু কারখানাটি গড়ে তোলা হয়েছিল। শুরুতে এ কারখানার কর্মকাণ্ড পরিচালনায় মেশিন শপ, পয়েন্টস অ্যান্ড ক্রসিং শপ ও গার্ডার ইয়ার্ড শপ নামে তিনটি উপ-কারখানায় প্রায় এক হাজার শ্রমিক কাজ করতেন।

রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের সব স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম শেডের মালামাল, রেললাইনের পয়েন্ট অ্যান্ড ক্রসিং, ব্রিজ গার্ডার, ট্রলি ও মোটরট্রলি মেরামত এবং তৈরি, মোটর গার্ডার, পানির ট্যাংক, ফুটওভার ব্রিজের মালামাল, ট্যাং স্টেজিংসহ ১০০ ধরনের মালামাল তৈরি হতো এ কারখানায়।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত কারখানাটিতে প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। কিন্তু ১৯৯১ সালে রেলওয়ের ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে তৎকালীন সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’ ঘোষণা দিলে ওই সুবিধা নিয়ে অনেক শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি ছেড়ে অবসরে যান।

পরবর্তীতে মঞ্জুরিকৃত ১২৭টি পদের মধ্যে নিয়মিত অবসরে যেতে যেতে মাত্র ছয়জন শ্রমিক-কর্মচারীতে নেমে আসে। ফলে ২০১৪ সালে এটিকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ঘোষণার পর ২০১৮ সালে কারখানাটির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: