সাতপোয়া ইউনিয়নবাসীর নিজেদের তৈরী ৩০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে কাঠের ব্রীজই ভরসা

প্রকাশিত: ২৯ মে ২০২৩, ০২:০০ পিএম

জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলা সদরের সাথে সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর উপজেলা ও মাদারগঞ্জ উপজেলার ভৌগলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাতপোয়া ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিন উপজেলার প্রায় ৩০টি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ নদীমাত্রিক এই ইউনিয়ন দিয়ে চলাচল করে থাকেন। উপজেলার সাতপোয়া ইউনিয়নের রৌহা ও চুনিয়াপটল গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা শাখা নদীতে যাতায়াতের ক্ষেত্রে খেয়া নৌকা ব্যবহার করতে হতো। সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রাম, মাদারগঞ্জের বারইপাড়া, খামার মাগুড়া, ডাকাতিয়া, বারমাইশা সিধুলিসহ সাতপোয়া ইউনিয়নের চর চুনিয়াপটল, রৌহা, নান্দিনা, সিংগুরিয়া, সাতারিয়া পূর্বপাড়া, মাঝারিয়াগ্রাম, হাটবাড়ী, জামিরা, চুনিয়া পটল, আদ্রার উত্তর অংশ, পশ্চিম আদ্রাসহ ৩০টি গ্রামের প্রায় লক্ষ মানুষ কষ্টকর যাতায়াত করে আসছিল। বন্যার সময় নদী পারাপারে নৌকাডুবির ঝুকি ও সময়ের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে যাতায়াত করতো। পরে নদীর পানি কমে গেলে নূন্যতম যাতায়াতের জন্য বাঁশের সাঁকো দিয়ে পারাপার হতো। সংসদ নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীরা বারংবার ব্রীজ নির্মানের প্রতিশ্রæতি দিলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। জনগুরুত্বপূর্ণ ব্রীজ নির্মানের জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় প্রশাসনের নিকট দাবী এবং দেনদরবার করেও ব্যর্থ হয়ে সরকারের উন্নয়ন জোয়ারে অবশেষে নিজেদের সমস্য সমাধানে গত বছর নিজেরাই কাঠের ব্রীজ নির্মানের পদক্ষেপ নেয়। নদী পারাপারে জনদুর্ভোগ দূর করতে সাতপোয়া ইউনিয়নের রৌহা পূর্ব চুনিয়াপটল গ্রামের আরএনসি ঈদগাহ মাঠের পাশ দিয়ে প্রবাহিত যমুনা শাখা নদীতে (স্থানীয় ঝারকাটা নদী) নিজেদের অর্থায়নে ও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাঠের ব্রীজ নির্মান করা হয়। ইউনিয়নবাসীর সহযোগিতায় প্রায় ৩৩০ ফুট দৈর্ঘ্য, ২০ ফুট উঁচু ও ৮ ফুট প্রস্থ ব্রীজ তৈরির পাশাপাশি দক্ষিণ চুনিয়াপটল গ্রামে তালুকদার বাড়ী বটতলা এলাকায় নদীর উপর আরও একটি ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্য কাঠের ব্রীজ নির্মান করা হয়। এ ছাড়াও রৌহা পশ্চিম জামিরা এলাকা যমুনা শাখা নদীর উপর অপর একটি ৩২০ ফুট দৈর্ঘ্য ১৮ ফুট উঁচু ও ৮ ফুট প্রস্থ কাঠের ব্রীজ নির্মান করে এলাকাবাসী। প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে কাঠে ব্রীজগুলো নির্মিত হওয়ায় বিশাল এলাকার জনগোষ্ঠি ব্যবসা বানিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুবিধা ভোগ করছে। স্বেচ্ছাশ্রমে এবং নিজেদের অর্থায়নে এই কাঠের নির্মিত ব্রীজটি চলাচলের ক্ষেত্রে অনেক কষ্টের অবসান ঘটেছে। তবে চুনিয়াপটল, আদ্রা গ্রামের রাস্তা-ঘাটের দূরাবস্থা চরম আকার ধারন করেছে। বেহাল রাস্তায় ক্ষুদ্র যানবাহন চলাচল অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ। বর্ষাকালীন সময়ে কয়েকটি গ্রামের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, অসুস্থ্য রোগীর চিকিৎসা সেবা, জনসাধারণ মানুষের যাতায়াত ও উৎপাদিত ফসলাদি পরিবহণ এবং বাজারজাত করণের নিত্যদিনের কষ্ট লাঘব হয়েছে। সাতপোয়া ইউনিয়নে যমুনা শাখা নদীর উপর তিনটি সেতু নির্মান, রাস্তা নির্মান বা সংস্কার হলে উপজেলা সদরের সাথে কাজিপুর, মাদারগঞ্জের বেশ কয়েকটি গ্রামে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে পণ্য পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হবে বলে স্থানীয়রা জানান।

বিশেষ করে উপজেলার ১নং সাতপোয়া ইউনিয়নের চুনিয়াপটল, রৌহা ও নান্দিনা গ্রাম উন্নয়ন বঞ্চিতের অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২৯মে সরেজমিনে গেলে গ্রামের রাস্তা-ঘাট নির্মান/সংস্কার, ব্রীজ-কালভার্ট নির্মানের জন্য মাতব্বরসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ অভিযোগ করেন। গ্রামে নিজেদের অর্থায়নে কাঠের তিনটি ব্রীজই চলাচলে একমাত্র ভরসা উল্লেখ করে গ্রামের রাস্তা ঘাটের দূরবস্থার চিত্র তুলেধরে নিজেদের বঞ্চনার কথা সংবাদ মাধ্যমকে অকপটে জানান। তারা ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের চুনিয়া পটল কালু ফকিরের বাড়ির মোড় হতে দক্ষিণ দিকে তালুকদার বাড়ি কাঠের ব্রীজ পর্যন্ত রাস্তা চলাচলে অনুপযোগী উল্লেখ করে দ্রæত মেরামত/সংস্কারের দাবী জানান। জানাগেছে, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির ২০২১-২২ইং অর্থ বছরের ২য় পর্যায়ের (ওয়েজ কষ্ট খাতের) ৬নং ওয়ার্ডের চুনিয়া পটল কালু ফকিরের বাড়ির মোড় হতে দক্ষিণ দিকে তালুকদার বাড়ি কাঠের ব্রীজ পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের অর্থ বরাদ্ধ আসে। সংস্কারের কোন কাজ না হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে সরকারের কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। গ্রামের ফজল মন্ডল বলেন, চলাচলে ভীষন অসুবিধা। রোগীকে ঘাড়ে নিয়ে চিকিৎসা করাতে যেতে হয়। রাস্তা ভাল না থাকার কারনে গাড়ী-ঘোড়া চলেনা। গত ১৫/২০ বছর ধরে রাস্তা সংস্কারের কাজ হয়না বলে তিনি অভিযোগ করেন। উত্তর চুনিয়াপটলের মোঃ আমজাদ হোসেন বলেন, আমাদের গ্রামে ৭/৮ হাজার মানুষ রয়েছে। রাস্তার কারনে রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার আগেই মারা যায়। নিজেদের টাকায় গ্রামে বিদ্যুৎ এনেছি। গ্রামের যাতায়াতের জন্য আমরা ২০ লাখ টাকা খরচ করে দুই পাশে দু’টি কাঠের ব্রীজ নির্মান করেছি। তিনি সরকারের নিকট রাস্তা সংস্কার ও গ্রামের দুইটি ব্রীজ নির্মানের দাবী জানান। একই গ্রামের আকবর আলী বলেন, চেয়ারম্যান ম্যাম্বাররা আশ্বাস দেয় কিন্তু কাজ করে না। ছাতারিয়া গ্রামের গোলাম মোস্তফা বলেন, আমাদের অসুবিধা চেয়ারম্যান ম্যাম্বাররা চাইয়াও (তাকিয়েও) দেখে নাই। রাস্তার বরাদ্ধ নেতারা খাইয়া ফালায় দাবী করে এলাকাবাসী দ্রæত রাস্তার (সংস্কারের) কাজ করতে সরকারের নিকট দাবী করেন। চুনিয়াপটল গ্রামের হেলাল মিয়া বলেন, প্রতি বছরই আশ্বাস দেয়, নেতারা কাজ করবো করবো বলে, করে না। রাস্তা গাতাগুতা (গর্ত) গাড়ী দিয়ে ফসল বাজারে নিতে পারিনা। দশ বছরের বেশী হয় রাস্তার কোন কাজ হয়না। রাস্তা হলে রোগীদের চিকিৎসা করা, বাজারে যাতায়াত করা সহজ হতো বলে মনে করেন তিনি। চুনিয়াপটল গ্রামের জুরমান আলী বলেন, আমাদের রাস্তা নাই, গাড়ী চলেনা তাই মাথায় করে বাজারে ধান নিয়ে যাচ্ছি। ছাতারিয়া বাজারে প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তা এভাবেই কষ্ট করে যেতে হবে। চুনিয়া পটল গ্রামের উসেন খা বলেন, নি¤েœ দশ বছরের মধ্যে এই রাস্তায় কোন কাজ হয় নাই। এর আগে রাস্তা কাইটা সমান করা হয়েছে বলে তিনি জানান। সাদ্দাম হোসেনসহ গ্রামের অনেক নারী পুরুষ সরকারের উন্নয়ন হতে চুনিয়াপটল গ্রাম বাদ পড়ার ফিরিস্তি দেন।

এ ছাড়াও সাতপোয়া ইউনিয়নে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির ২০২১-২২ইং অর্থ বছরে ২য় পর্যায়, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ১ম পর্যায়ের প্রকল্প গুলোর মধ্যে কোন কোন প্রকল্পে ড্রজার মেসিন দিয়ে নাম মাত্র দু চার দিন কাজ করা হয়েছে। কোন কোন প্রকল্পে দু’চারজন শ্রমিক লাগিয়ে রাস্তার মাটি ড্রেজিং কিংবা স্বল্প মাটি দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয়েছে। প্রকল্পে স্থানীয় কর্মহীন শ্রমিকদের কাজ দেয়ার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন। সরকারী অর্থে গ্রামিণ অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ না করে নাম মাত্র কাজ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি সঠিক তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারী উর্ধ্বতন মহলের নিকট জোর দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

১০নং শিশুয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আঃ রাজ্জাক বলেন, সাতপোয়া ইউনিয়নে যমুনা শাখা নদীর উপর তিনটি ব্রীজ নির্মান জরুরী।

কাজীপুরের মনসুরনগর ইউনিয়নের সাদাপ্লট গ্রামের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'প্রমত্তা যমুনার কারণে আমরা কাজীপুর উপজেলা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন। কয়েকটি গ্রামের লোকজনকে প্রয়োজনে সরিষাবাড়ী সদরে যেতে হয়। ব্রীজ না থাকায় আমাদের অনেক দূর্ভোগ পোহাতে হয় বলে তিনি জানান।
প্রকল্পের ট্যাগ অফিসার আওরঙ্গজেব জানান, বিষটি আমি সঠিক ভাবে বলতে পারবনা। চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেন।

ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের নজরুল ইসলাম ম্যাম্বার বলেন, গত অর্থবছরে আমি ২১ দিনের কাজ পেয়েছিলাম। বরাদ্ধকৃত অর্থদিয়ে তালুকদার বাড়ী মোড় হতে উত্তরদিকে পুকুর পাড় পর্যন্ত কাজ করতে পেরেছিলাম।
উপজেলা উপসহকারী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শে ডিজি’র নিকট ২৫/২৬টি ব্রীজের চাহিদা পত্র দিয়েছি। এখনো কোনটাই অনুমোদন হয়নি বলে তিনি জানান।

এ ব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হুমায়ূন কবীর জানান, ইউনিয়নের ওয়ার্ড গুলোতে কাজ চলমান আছে।

এ বিষয়ে সাতপোয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু তাহের বলেন, রৌহা উত্তর ও দক্ষিনে নদীর উপর ব্রীজ নির্মানের আবেদনের প্রেক্ষিতে সার্ভে ও ডিও লেটার দেয়া আছে। তবে ড্রইং/ডিজাইন এখনো হয়নি বলে তিনি জানান। চুনিয়াপটল গ্রামবাসীর অভিযোগের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, গ্রামের লোকজন বললে তো হবে না। গত বছরেও রাস্তায় মাটি কাটা হয়েছে। ঝড় বৃষ্টিতে রাস্তার মাটি সরেগেছে। ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ড গুলোতে বর্তমান কর্মসূচী চলমান আছে বলে তিনি জানান।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: