বৃষ্টিতে ভিজতে ক্যাম্পাসের লেকপাড়ে গিয়েছিলেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের দুই শিক্ষার্থী মোবাশ্বেরা তানজুম হিয়া (২০) ও তাসফিয়া জাহান ঋতু (২০)। এ সময় পা পিছলে লেকের পানিতে পড়ে যান মোবাশ্বেরা। লেকের গভীরতা অনেক হওয়ায় মুহূর্তেই ডুবে যান তিনি। বান্ধবীকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দেন তাসফিয়া। এতে প্রাণ যায় তারও। দুজনের কেউই সাঁতার জানতেন না।
ঘটনাস্থলের আশেপাশে থাকা অন্য শিক্ষার্থীরা দ্রুতই তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন। আধঘণ্টা পর উদ্ধার করে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
মঙ্গলবার (১ আগস্ট) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের লেকে এ ঘটনা ঘটে। এতে নিহতদের সহপাঠীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। বিকেলে স্বজনদের কাছে নিহতদের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
জানা যায়, নিহত মোবাশ্বেরা তানজুম হিয়ার বাড়ি খুলনার বড়বাড়ি এলাকায় ও তাসফিয়া জাহান ঋতুর বাড়ি বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটের মাসকাটা এলাকায়। দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসঙ্গে থাকতেন শহরের নবীনবাগ এলাকার একটি ভাড়া বাসায়।
মোবাশ্বেরার লাশ বাড়িতে নিয়ে আসলে শত শত মানুষের ভিড় জমে। স্বজন, পাড়াপড়শিরা, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, বন্ধুরা সবাই শেষবারের মতো দেখতে আসেন মোবাশ্বেরাকে।
এ সময় মোবাশ্বেরার বাবা মো. মনিরুজ্জামান তাদের জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছিলেন। বিলাপ করতে করতে মো. মনিরুজ্জামান বলছিলেন, ‘আমাদের খুব ইচ্ছে ছিল মেয়েটা ডাক্তার হবে। চেষ্টা করেছিল, কিন্তু হয়নি। গত সপ্তাহে আমাকে বলল, ‘বাবা জিপিএ–৫ সব সময় পেয়ে আসছি, তারপরও ডাক্তার হতে পারিনি বলে হয়তো তোমার রাগ। দেখো বাবা, নসিবে হয়তো ছিল না। তবে এবার চারের মধ্যে চার পাওয়ার মতো পড়াশোনা করব।’
মোবাশ্বেরার সঙ্গে প্রতিদিন সকালে কথা হতো বাবা মনিরুজ্জামানের। নিয়মিত বাড়ি যাওয়া-আসা করতেন তিনি। ক্লাস-পরীক্ষা চলছিল বলে কয়েক দিন খুলনায় আসতে পারেননি। গতকাল তাদের ক্লাস-পরীক্ষা শেষ ছিল। মনিরুজ্জামান বলছিলেন, ‘সোমবার রাতে ভিডিও কলে শেষ কথা হয়েছে। ওরা দুই বান্ধবী বুধবার আমার বাসায় আসবে বলে জানিয়েছিল। ওরা একই রুমে থাকত। হলের বাইরে বালুর মাঠের পাশে একটা বাসায় থাকত। গত সপ্তাহে দুজন নতুন বাসায় উঠেছে। আমার মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে ওর বান্ধবী ঋতু (তাসফিয়া জাহান) মারা গেছে। ও যে স্যাক্রিফাইস করছে, সেটা কেউ করে না।’
মোবাশ্বেরা তানজুমেরা দুই ভাই-বোন ছিলেন। তিনি ছিলেন বড়। ছোটবেলা থেকেই তিনি মেধাবী ছাত্রী হিসেবে পরিচিত। খুলনা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় (মন্নুজান স্কুল) থেকে এসএসসি এবং খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। হিয়ার ছোট ভাই তাহমিদ আরাব খুলনা সিটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। বোনের অকালমৃত্যু তাহমিদকে অনেকটাই নির্বাক করে দিয়েছে। অনেকক্ষণ পরপর দু-একটা কথা বলছিল সে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজিব হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, হিয়া ও ঋতু খুব ভালো ছাত্রী ছিলেন। ক্লাস মেধাবীদের মধ্যে তারা দুইজন রয়েছেন। খুব মিশুকও ছিলেন তারা। তাদের এই করুন মৃত্যুতে আমাদের বিভাগে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শিক্ষক হিসেবে তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
নিহতদের উদ্ধারে অংশ নেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আকাশ বলেন, ওদের চিৎকার শুনে এসে দেখি দুজনে ডুবে গেছে। ওদের বাঁচাতে অনেক চেষ্টা করছি। কিন্তু বাঁচাতে পারলাম না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. কামরুজ্জামান বলেন, খবর পেয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি ঘটনাস্থলে পৌঁছে শিক্ষার্থীদের উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করি। এ ঘটনায় ক্যাম্পাস জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ কিউ এম মাহাবুব বলেন, দুই শিক্ষার্থীর নিহতের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করেছি। বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যাতে না ঘটে সে বিষয়ে খেয়াল করা হবে।
গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তদন্ত শীতল চন্দ্র পাল বলেন, বিকেলে স্বজন ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিহতদের মরদেহ বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর
ক্যাম্পাস এর সর্বশেষ খবর