সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে পরিমাণ উত্তেজনা বেড়েছে তা থেকে মানুষের মাঝে একটি প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তা হলো বিশ্ব কি আরেকটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে? এই প্রশ্নের মূল কারণ, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে বিভিন্ন দেশ নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বের এক প্রান্তে চলমান রয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ঠিক এর মাঝে মধ্যপ্রাচ্যে ১৯৪৮ সাল থেকে শুর হওয়া ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের সংকট।
সর্বশেষ ফিলিস্তিনের হামলায় ইরান, চীন, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া এবং সৌদি আরবসহ পশ্চিমা বিরোধী দেশগুলো ফিলিস্তিনের পক্ষে মত দেওয়ার কারণে এই সংকট আরো জুড়ালো হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এত সহজে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না পশ্চিমা দেশ যুক্তরাষ্ট্র। তারা ইসরায়েলে সৈন্য পাঠানোর কথা বললেও পরিশেষে সৈন্য পাঠায়নি দেশটি। কারণ, পশ্চিমা দেশগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে বিশ্ব অর্থনীতিক বাজার এবং বিশ্বে নতুন করে প্রভাব বাড়বে চীন-রাশিয়ার। ফলে বিশ্বে প্রভাব কমে যাবে ওয়াশংটনের। এমনকি জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র হামাসের হামলায় নিন্দা জানানোর প্রস্তাব তুললেও না পাস হয়নি রাশিয়ার কারণে। এতে রাশিয়া ফিলিস্তিনের পক্ষে মত দিয়েছেন।
তবে বিশ্বের প্রতিটি যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে পশ্চিমা দেশগুলো। কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া সিরিয়া তুরস্কের ড্রোন ভূপাতিত করেছে ওয়াশিংটন। এই নিয়ে ন্যাটোর দুই দেশ ওয়াশিংটন-আঙ্কারার মাঝে সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়েছে। ঠিক একই সময়ে ন্যাটো হস্তক্ষেপ করেছে সার্বিয়া-কসোভোর সংকটে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর কসোভোর উত্তরাঞ্চলীয় বাঞ্জস্কায় একটি থানায় সার্ব আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের হামলা ঘিরে উত্তেজনার পারদ চড়েছে। দেশ দুটি আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে কি না, এখন সেই শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সীমান্তে সার্বিয়া সৈন্য বৃদ্ধি করছে বলে এমন খবর পেয়ে ন্যাটো জোটের থাকা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার সৈন্যসহ মোট ৫ হাজার অধিক সেনা মোতায়েন করেছে ন্যাটো কসোভোর সীমান্তে। এই দুই দেশের যুদ্ধ শুরু ২০০৮ সাল থেকে। তখন কসোভো একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণায় বিশে^ ৯৯টি দেশ তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু সার্বিয়া কখনোই কসোভোকে স্বীকৃতি দেবে না বলে অঙ্গীকার করেন প্রধানমন্ত্রী ভুসিস। দেশটির মিত্র রাশিয়া ও চীন জাতিসংঘে কসোভোর সদস্য হওয়া আটকে রেখেছে। ফলে এই নিয়ে ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমা এবং রাশিয়া-চীনের মধ্যে।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো পক্ষ এখনো যুদ্ধের সীমারেখা টানছে না। কারণ, এই যুদ্ধে জড়িয়ে আছে রাশিয়া-আমেরিকার বিশে^র প্রভাব। তাই কেউ আগ বাড়িয়ে সমঝোতার আগ্রাহ দেখাচ্ছে না, হারও মানছে না। অনেকে এই যুদ্ধকে ছায়া যুদ্ধ বা স্নায়ো যুদ্ধ বললেও এখন এটা সরাসরি যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। শুরু থেকেই যুদ্ধের প্ররোচনা দিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটনসহ তা মিত্ররা। শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ডনবাস সমস্যার সমাধান হতে পারতো। উল্টো আমেরিকা ও ন্যাটো একের পর এক সমরাস্ত্র-বোঝাই মার্কিন ও ব্রিটিশ বিমান ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে নামিয়েছে। ফলে তাদের এই দুই দেশের যুদ্ধ এখনও বিরাজমান রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘাত হলেও বিশ্ব নেতাদের আকর্ষণ এখন মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকটের দিকে। দীর্ঘ ৭০ বছরের ইতিহাসে হামাস এইবার সরাসরি ইসরায়েলে প্রবেশ করে অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু এর জের ধরে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের উপর ধাপে ধাপে রকেট হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতাগামী সংগঠন হামাসও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক একই সময়ে লেবানন ও সিরিয়া থেকে হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ সংগঠনটি।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর পারমাণবিক দেশগুলো দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও চলমান রয়েছে তাদের সংঘাত। কারণ আন্তর্জাতিক মহল এটা সমাধানের মাথা ঘামাচ্ছে না। যদি আজকে ফিলিস্তিনের জায়গা ইসরায়েল হতো হয়ত পশ্চিমা দেশগুলো উঠেপড়ে লাগত। তবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের যুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে রাশিয়া। তখন, পশ্চিমা দেশগুলোর নজর ইউক্রেন থেকে সরে গিয়ে ইসরায়েলের উপর পড়বে।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৯৫০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ইসরায়েলে নিহত হয়েছে ১২০০। ইসরায়েলি বোমা হামলার কারণে মিসরের রাফাহ ক্রসিং বন্ধ হয়ে গেছে যা অবরুদ্ধ গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ। এমনকি ইসরায়েল বিমান হামলায় গাজার আল-কারামা এলাকায় আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ সাদা ফসফরাস বোমা ফেলেছে ইসরায়েলি বাহিনী, দাবি করেছেন ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটা নিয়েও ক্ষোভ জানিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন। নিষিদ্ধ ফসফরাস থেকে বাহির হওয়ার আগুনে ঝলসে মারা যেতে পারে বহু মানুষ।
অন্যদিকে কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো ভারতের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ৪০ কূটনীতিককে সরিয়ে নিয়েছে। শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ড জের ধরে ভারত-কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সম্প্রতি কানাডিয়ান শিখ নেতা হারদীপ সিং নিজ্জারকে হত্যায় ভারতের জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। এরপরই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়।
সম্প্রতি সময়ে বিশে^ বিভিন্ন দেশের যে সংঘাত তা এড়িয়ে যাওয়ার নয়। জাতিসংঘে যে মানবাধিকার আইন রয়েছে তা যেন কোনো কাজে আসছে না। ইসরায়েল মানবাধিকার আইন লঙ্গন করে সাদা ফসফরাস (বোমা) ব্যবহার করেছে। যা আন্তর্জাতিক অপরাধ বলে জানান ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। উন্নত দেশ থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল দেশসহ সবাই নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন নিয়ে ব্যস্ত। এই সংঘাতের কারণে প্রভাব পড়ছে বিশ্ব বাজারে। এমনকি চেচেন প্রজাতন্ত্রের প্রধান রমজান আখমাদোভিচ কাদিরভ ফিলিস্তিনে শান্তি রক্ষার জন্য বাহিনী পাঠাতে প্রস্তুত।
আর অন্যদিকে ওয়াশিংটন সৈন্য পাঠানোর কথাও ভেবেছিলেন, তাহলে কি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকটে সরাসরি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ শুরু হয়েছে। যারা শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত তারাই যদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে বিশ্বে শান্তি কীভাবে ফিরে আসবে? প্রতিটি যুদ্ধে ধ্বংস হয়েছে মধ্যবিত্ত দেশগুলো, যার উদাহরণ হলো সিরিয়া, ইরাক। যে উদ্দেশ্য নিয়ে জাতিসংঘ গঠন করা হয়েছে তা যেন দ্রুত বাস্তবায়ন হয়। তবে লেবাননের একটি গোষ্ঠী ইজরায়েলে হামলা চালিয়েছে হাইফা শহরে। আমেরিকা সরকার লেবাননে অবস্থিত সকল আমেরিকা নাগরিককে লেবানন ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এমনকি আমেরিকা ইসরায়েলে যুদ্ধ অস্ত পাঠাতে শুরু করেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে বিশ্ব আরেকটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।
লেখক: মোহাম্মদ শাহীন আলম (শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর