বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নৌযান চলাচল, স্থাপনা তৈরিসহ নানান কারণে গত কয়েক দশকে এই বদ্বীপ’র পরিবেশের ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। খুব শিগগিরই সুন্দরবনের পরিবেশ রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে নিজস্ব সৌন্দর্য হারাবে এই বদ্বীপ। পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়বে সুন্দরবন ও বাংলাদেশ।
আইলা, বুলবুল, সিডর, আম্পান, ইয়াশের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে সুন্দরবন।এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে লাখ লাখ গাছ ভেঙ্গে পড়েছে। বনের মধ্যে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রজাতির হাজার হাজার প্রাণী মারা গেছে। আহত হয়েছে সহস্রাধিক প্রাণী।
বন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চোরাকারবারিরা গাছ কেটে উজাড় করে দিচ্ছে সুন্দরবন।চোরা শিকারিরা সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ শিকার করছে প্রতিনিয়ত। এতে দিনে দিনে কমছে সুন্দরবনের বাঘ ও হরিণের সংখ্যা। এছাড়াও গত দুদশকে সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে ১৩টি স্থাপনা। এসব তিন তলা স্থাপনাগুলো সাইক্লোন সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটা প্রাথমিকভাবে উপকূলীয় মানুষের উপকারে আসলে সুন্দরবনের পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। এসব ভবনের পাশাপাশি বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলাবাহিনী নিজেদের ক্যাম্পের জন্য তৈরী করেছে ভবন। এতে বড় বড় সার্চ লাইট ব্যবহার করা হয়েছে এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর ২৪ ঘণ্টা চালু থাকায় বনের প্রাণীরা সব সময় ভীত হয়ে থাকে। সার্চ লাইট ও জেনারেটরের উচ্চ আওয়াজে বনের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
সূত্রটি আরও জানায়, সুন্দরবন এলাকা দিয়ে বড় বড় জাহাজ ও জেলেদের ট্রলার চলাচল করে। বনের ভেতর দিয়ে ৬০ শতাংশ এবং বনের বাহির দিয়ে ৪০ শতাংশ নৌযান চলাচল করে। জাহাজের হাইড্রোলিক হর্ণ ও জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দ বনের প্রাণীদের আতঙ্কিত করে তুলছে।এছাড়াও বছরের অর্ধেকের বেশি সময় বনে জেলে ও কাঠ আহরণকারীদের অবস্থান থাকে। জেলেরা সুন্দর বনের খালে বিশ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করে। এতে সুন্দরবন ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং মানুষের কোলাহল থাকায় বনায়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে এবং প্রাণীদের অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত এক দশকে সুন্দর বনের ভেতরের নদের প্রতি লিটার পানিতে তেলের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৮ মিলিগ্রাম। তা বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৬৮ মিলিগ্রামে, যেখানে স্বাভাবিক মাত্রা হলো ১০ মিলিগ্রাম। এসব নদের পাশে এখন আর চারা গাছ গজাচ্ছে না। এছাড়াও এসব এলাকায় এখন আর আগের মতো বন্য প্রাণীদের দেখা মেলে না।
একটি সূত্রে জানা গেছে, গত দুই দশকে সুন্দরবনে আগুন লেগেছে অন্তত ২৪ বার, যাতে ৮২ একর বনভূমির গাছপালা পুড়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি আগুন লেগেছে ২০০৬ ও ২০১৬ সালে। এ দুই বছরে সুন্দরবনে নয়বার আগুন লেগেছে। যাতে প্রায় ১৭ একর বনভূমি পুড়ে গেছে।
প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় কারণেই সুন্দরবন ইতোমধ্যে হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে। প্রকৃতি সংরক্ষণ-বিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন সুন্দরবনকে ‘বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করেছে। ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যে সুন্দরবনের অবস্থানের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অনেক আগেই বিবৃতি দিয়েছে। এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও মিষ্টি পানির সরবরাহ হ্রাস পেয়ে বনে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি তো রয়েছেই।
সুন্দরবনে আছে প্রায় ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৩২০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি আর প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ। এছাড়া অগণিত কীটপতঙ্গও আছে এ বনে। তাই বাংলাদেশের এই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় এর পরিবেশ ঠিক রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে শীঘ্রই নিজস্ব ঐতিহ্য হারাবে এ বন।
এ বিষয়ে সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসীন হোসেন বলেন, সুন্দরবনকে আমরা সব সময় তার নিজ মহিমায় ফেরাতে চাই। ইতোমধ্যে ৫২ শতাংশ বনকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এর ওপর নির্ভরশীল মানুষের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বনজ সম্পদ সংরক্ষণে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে।
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর আনোয়ারুল কাদির বলেন, বনের পরিবেশ এবং বন্যপ্রাণীর বসবাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো স্থাপনা তৈরি করা আত্মঘাতী কাজ। একই সঙ্গে উচ্চ শব্দ প্রাণীরা গ্রহণ করতে পারে না। তাই সুন্দর বনকে তার নিজস্ব পরিবেশ ফিরিয়ে দিয়ে এ প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করতে হবে।
সর্বশেষ খবর