
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশকে মেরে ঝুলিয়ে রাখার খবর ও ছবি খুব একটা প্রচারে আসেনি বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালানোর নির্দেশনা ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় জন সমন্বয়কের ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তির নির্দেশনা চেয়ে রিটের শুনানিতে মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান পান্না, ব্যারিস্টার অনীক আর হক, অ্যাডভোকেট মানজুর আল মতিন প্রীতম প্রমুখ। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মো. মোরসেদ ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মেহেদী হাছান চৌধুরী।
শুনানিকালে ব্যারিস্টার অনীক আর হক বলেন, পুলিশকে যদি গুলি চালাতেই হয়, তবে পায়ের দিকে লক্ষ্য করে গুলি করতে হবে। রাতের বেলায় কেউ ডাকাতি করতে গেলে আত্মরক্ষার্থে সরাসরি গুলি করতে পারবে।
তখন আদালত বলেন, এমন কোনও কাজ করবো না যাতে জাতির ক্ষতি হয়। সব মৃত্যুর ঘটনাই দুঃখজনক। কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা লজ্জিত।
অনীক আর হক বলেন, জাতির ক্ষতি বলতে শুধুমাত্র কিছু ভবন, স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি বুঝালে হবে না, জীবনের ক্ষতিও জাতির ক্ষতি। আগে বিক্ষোভ দমন বা ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গরম পানি, মরিচের গুড়া ব্যবহার করতো।
আদালত তখন বলেন, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ব্যবহার করা যেতে পারে। তার আগে মাইকিং করে সতর্ক করতে হবে। আমরা কেউই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছি না। পুলিশ কখন আর্মি কল করতে পারে সেটিও আইনে বলা আছে। পুলিশকে যে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল তার খবর ও ছবি খুব একটা প্রচারে আসে নাই।
আইনজীবী সারা হোসেন আদালতকে বলেন, ছয় সমন্বয়ককে যে হেফাজতে রাখা হয়েছে, এটা তো স্বীকৃত। আইন কর্তৃত্ববহির্ভূতভাবে কাউকে এভাবে হেফাজতে রাখার সুযোগ নাই। আইনি ক্ষমতার বাইরে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। বলা হচ্ছে যে তাদের আত্মীয়-স্বজনরা দেখা করতে পারছে। কিন্তু তারা (ছয় সমন্বয়ক) কার সঙ্গে দেখা করতে চায় বা চায় না সেটা জানার কোনও সুযোগ নেই। তার মানে একটি নিয়ন্ত্রণ চলছে।
আদালত বলেন, প্রসেসের ভেতরে আটকাতে হবে। হয় রিমান্ডে নেন, নয় কোর্টে তুলুন।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলর এস এম মুনীর বলেন, একটা লোকের জীবন হুমকিতে আছে, তাকে মেরে ফেলবে।
আদালত বলেন, তাকে যে মেরে ফেলবে সে কথাটা তাকেই বলতে হবে। সে তো আশ্রয় চায় নাই।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, রিট আবেদনকারীরা ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার জন্য এসেছেন। তারা একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছেন। এখানে যারা এসেছেন তারা সবাই এই কমিশনের সদস্য। তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। কমিশনের চেয়ারম্যান একজন আবেদনকারীর বাবা। জাতিসংঘের একটি চার্টার উদ্বৃত্ত করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। ওই চার্টার অনুসারে অনুপেক্ষিত ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারীরা গুলি চালাতে পারবে। কোনটা অনুপেক্ষিত পরিস্থিতি, সে সিদ্ধান্তও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেই নিতে হবে। এটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।
এরপর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারলে শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, আমরা কোর্টের ভেতরে আছি। আইনের মধ্য থেকে কথা বলবো। এমন কিছু বলবো না যাতে কেবল মিডিয়া কাভারেজ পাওয়া যায়।
আদালত তখন বলেন, বিষয়টি সব পক্ষেরই খেয়াল রাখা দরকার। এখন দেশে যে অবস্থা সে পরিস্থিতিতে ছয় সমন্বয়ককে পুলিশ আটক রাখতে পারে কিনা?
তখন আইন কর্মকর্তা মোরশেদ বলেন, দেশে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কাকে কীভাবে রাখবে সে সিদ্ধান্ত তাদেরই নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কোটা নিয়ে আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন, সেখানে সর্বোচ্চ আদালত কিছু পর্যবেক্ষণও দিয়েছেন। আদালত আশা প্রকাশ করেছেন, যে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে সে কমিশন প্রত্যেকটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। তা সত্ত্বেও তারা গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছে।
সভা-সমাবেশের অধিকার নিয়ে এ আইন কর্মকর্তা বলেন, আইনি বিধি-নিষেধ সাপেক্ষে সভা-সমাবেশের অধিকার দেওয়া হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে বল প্রয়োগ করেছে, তার কোনও প্রমাণ তাদের কাছে নেই।
এক পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘সংবিধান ও আইনে সব বিষয় লেখা আছে। কিন্তু আমরা কেউ সংবিধান, আইন মেনে চলছি না।’
পরে এ মামলার পরবর্তী শুনানি ও আদেশের জন্য আগামীকাল বুধবার (৩১ জুলাই) দিন নির্ধারণ করেন হাইকোর্ট।
এর আগে গত ২৯ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালানোর নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। একইসঙ্গে রিট আবেদনে কোটা আন্দোলনের ৬ জন সমন্বয়কের ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তির নির্দেশনা চাওয়া হয়। হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর আল মতিন প্রীতম ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা লিপি এ রিট দায়ের করেন।
রিটে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, সেনাবাহিনী প্রধানসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়।
প্রসঙ্গত, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সারাদেশে গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ, সহিংসতা ও বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বেশকিছু হতাহতের ঘটনা ঘটে। এদিকে কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নিজ হেফাজতে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ডিবি।
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর