
দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য আমদানি করা জ্বালানি তেল (পেট্রোলিয়ম) খালাস দ্রুত, সহজ ও সাশ্রয়ী করার জন্য ইন্সটলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
জ্বালানি খাতের অন্যতম এই বড় প্রকল্পটি পরিচালনার টেন্ডার আহ্বান করা হবে চলতি মাসেই। ইতোমধ্যে শেষ পর্যায়ে রয়েছে উন্মুক্ত টেন্ডারের জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস তৈরির কাজ। টেন্ডারের পর সাগর থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হবে। এতে বছরে সাশ্রয় হবে ৮০০ কোটি টাকা।
সূত্রে জানা যায়, বছরে ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ১৩ থেকে ১৪ লাখ টন অপরিশোধিত (ক্রুড অয়েল) এবং ৫৬ থেকে ৫৭ লাখ টন পরিশোধিত (রিফাইনড অয়েল) জ্বালানি তেল আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধনের পর তেল বিপণন কোম্পানির মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়।
জানা যায়, বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের পুরোটাই আমদানি হয় সাগরপথে। আমদানিকৃত তেল নিয়ে আসা বড় বড় মাদার ভ্যাসেল বন্দর চ্যানেলে বার্থিং নিতে পারে না। এসব জাহাজ বহির্নোঙরে অবস্থান করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) লাইটারেজ জাহাজ এমটি বাংলার জ্যোতি এবং এমটি বাংলার সৌরভের মাধ্যমে তেল লাইটারিং করত। এ প্রক্রিয়া ছিল সময়সাপেক্ষ।
একেকটি মাদার ভ্যাসেল থেকে তেল খালাস করতে ১১ থেকে ১২ দিন সময় লাগে। বিপুল অর্থ জড়িত থাকে এই প্রক্রিয়ায়। এতে শুধু লাইটারেজ জাহাজের ভাড়া নয়, একইসাথে দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকা মাদার ভ্যাসেলগুলোর ভাড়া বাবদও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয় বিপিসিকে।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারের মাতারবাড়ী দ্বীপের স্টোরেজ ট্যাংক থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে সাগরে অবস্থিত ভাসমান বয়াটি ২২০ কিলোমিটার সমান্তরাল দুইটি পাইপলাইনের সাথে সংযুক্ত। এরমধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার পাইপলাইন অফশোর বা সাগরের তলদেশে, এবং ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইন অনশোর বা স্থলভাগ স্থাপন করা হয়েছে।
মাদার ট্যাংকার জাহাজ থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রথমে মহেশখালীর ট্যাংক টার্মিনাল, এরপর সেখান থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাংক টার্মিনালে নিতে এগুলো স্থাপন করা হয়েছে। চীনের অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
প্রকল্প নিরীক্ষায় বলা হয়েছে, এতদিন আমদানি করা জ্বালানি তেল বড় জাহাজ থেকে ভাড়া করা লাইটার জাহাজে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ট্যাংকে আনা হতো। এতে সময় লাগত ১১ থেকে ১২ দিন। প্রকল্পটি চালু হলে সমপরিমাণ তেল পরিবহনে সময় লাগবে মাত্র দুই দিন। এতে বছরে সাশ্রয় হবে ৮০০ কোটি টাকা।
প্রকল্পের আওতায়, মহেশখালীতে ছয়টি স্টোরেজ নির্মাণ করা হয়, যা ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) জ্বালানি তেল ধারণের সক্ষমতা দুই লাখ টন বাড়ায়। ফলে এখন আড়াই মাসের চাহিদার সমান তেল মজুদ করা সম্ভব। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কারণে সরবরাহ ব্যাহত হলে যা অতিরিক্ত নিরাপত্তা মজুদ থাকার সুবিধা যোগ করেছে।
সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের এমটি বাংলার জ্যোতি এবং এমটি বাংলার সৌরভে অগ্নিকাণ্ডের পর ট্যাংকার দুইটি এখন অচল। সেজন্য বিপিসি একটি ট্যাংকার বিদেশ থেকে ভাড়া করে নিয়ে এসেছে। অথচ পাইপলাইনে জ্বালানি তেল খালাস হলে ট্যাংকারের প্রয়োজনই হতো না। এখন দুই খাতেই সরকারকে ব্যয় টানতে হচ্ছে। প্রথমত, ট্যাংকারের মাধ্যমে পরিবহনে প্রতি মাসে ৬৬ কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, পাইপলাইন স্থাপনের এসপিমএম প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণও পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে।
এসপিএম প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, জাহাজ থেকে তেল খালাসে সময় এবং অর্থ সাশ্রয় করতে গভীর সাগরে একটি ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালে প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন লাভ করলেও অর্থাভাবে ঝুলেছিল। পরে প্রকল্পটিতে অর্থায়নে চীন সরকার আগ্রহ দেখায়। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা হয়।
পরে ২০১৯ সালের শুরুতে চীন সরকারের প্রিফারেন্সিয়াল ঋণ সুবিধার সহায়তায় ডুয়েল-চ্যানেল এসপিএম ব্যবস্থার নির্মাণকাজ শুরু হয়, যেখানে অর্থায়ন করে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না। চীন প্রিফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট বাবদ ৪৬৭ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন এবং সফট লোন বাবদ ৮২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার দেয়।
বার্ষিক ২ শতাংশ সুদে ২০ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে, আর গ্রেস পিরিয়ড হচ্ছে পাঁচ বছর। বেশ কয়েকবার সংশোধনের পরে প্রকল্পের সময় বাড়ানো হয়। একইসাথে অতিরিক্ত নির্মাণ কাজ, ডলারের বিনিময় হারে পরিবর্তন ও করের কারণে ব্যয় ৪ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয় ৮ হাজার ২২২ কোটি টাকা। অবশেষে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে সৌদি আরবের ৮২ হাজার টন একটি জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ (মাদার ভেসেল) থেকে প্রথমবারের মতো পাইপলাইন দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে জ্বালানি তেল সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
তখন একটি বড় কারিগরি ত্রুটির কারণে সাগর থেকে পাইপলাইনে মহেশখালীর কালারমার ছড়ায় তেল নিয়ে আসার উদ্যোগটি ভেস্তে যায়। পরে ত্রুটি সারিয়ে তা শুরু করতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। প্রকল্পের মেয়াদ সবশেষ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল, অবশেষে প্রকল্প হাতে নেওয়ার ৯ বছর পরে মার্চে এটি কমিশনিংয়ে আসে।
বিপিসি কর্মকর্তারা বলেছেন, মহেশখালীর স্টোরেজ টার্মিনাল থেকে পাম্প করে ৬০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি স্টোরেজে পাঠাতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৭ ঘণ্টা। ধীরে ধীরে চাপ বাড়িয়ে একই পরিমাণ তেল ১২ ঘণ্টায় পৌঁছানা সম্ভব। আর ৬০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার জ্বালানি তেল খালাস করতে সাগর থেকে পতেঙ্গা ডলফিন জেটি পর্যন্ত পৌঁছাতে ২০টি ছোট ট্যাংকারের জাহাজ প্রয়োজন হবে। এই পরিমাণ তেল খালাস করতে স্বাভাবিক সময় লাগতো ৭-৮দিন। ফলে পাইপলাইনে তেল পরিবহনে সিস্টেম লস কমবে, সময়-অর্থ দুটোই সাশ্রয় হবে।
বিপিসির কর্মকর্তারা বলেন, প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল প্রথম ১৮ মাস একটি দক্ষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসপিএম পরিচালনা করা হবে, আর দ্বিতীয় বছর থেকে পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বিপিসি কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন এর পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) ও যুগ্ম সচিব অনুপম বড়ুয়া বলেন, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন পরিচালনার জন্য চলতি মাসেই টেন্ডার আহ্বান করা হবে। ইতোমধ্যে উন্মুক্ত টেন্ডারের জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে।
উন্মুক্ত টেন্ডারের পর সাগর থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বছরে অন্তত ৮শ’ কোটি টাকা যেমন সাশ্রয় হবে সেই সাথে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাও সুরক্ষিত হবে।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর