
কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপে সরকারি খাসজমিতে গড়ে ওঠা প্যারাবন ধ্বংস করে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে সাতটি নতুন চিংড়িঘের। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের এ মহোৎসবে এবার মামলা হয়েছে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের ২০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে।
অভিযোগ উঠেছে, যাদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে ও ছত্রছায়ায় সোনাদিয়ার প্যারাবন ধ্বংস করে ঘের নির্মাণ হয়েছে, তাদের অনেকেই এজাহারে নামই ওঠেনি। রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক যোগসাজশ এবং টাকার প্রভাবেই মূল হোতারা থেকে গেলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
মামলায় নাম থাকা কিছু লোককে ‘বালি ঢাকতে সোহাগা’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। অর্থাৎ মামলার মাধ্যমে যেন জনমত শান্ত করা ও মিডিয়াকে ঠান্ডা রাখার কৌশল নেওয়া হয়েছে। এতে করে মামলাটি প্রকৃতপক্ষে আইনি প্রদর্শনীতে রূপ নিয়েছে- যার উদ্দেশ্য দোষীদের বিচারের আওতায় আনা নয়, বরং দায়সারা একটা বার্তা দেওয়া যে, "কিছু একটা করা হয়েছে"।
দীর্ঘদিন ধরে সংকটাপন্ন এলাকা (Ecologically Critical Area - ECA) হিসেবে চিহ্নিত সোনাদিয়া দ্বীপে অব্যাহতভাবে প্যারাবন ধ্বংস করে চলছে জমি দখল ও চিংড়িঘের বানানোর উৎসব। সবশেষ তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস হয়েছে প্রায় এক হাজার একর কেওড়া ও বাইনগাছের বন।
গত বৃহস্পতিবার একাধিক গণমাধ্যমে ‘প্যারাবন পুড়িয়ে নতুন চিংড়িঘের’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরই ধারাবাহিকতায় পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র কেমিস্ট মো. আবদুছ ছালাম বাদী হয়ে মহেশখালী থানায় মামলা দায়ের করেন।
মামলায় যে-সব নাম রয়েছে, তারা কেউ বিএনপির ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক, কেউ চেয়ারম্যান, কেউ আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের স্থানীয় নেতা। মোট ২০ জন এজাহারভুক্ত এবং আরও ২৫-৩০ জন অজ্ঞাতনামা।
আসামিদের মধ্যে রয়েছেন, বিএনপি নেতা আলমগির চৌধুরি, ইউপি চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা অ্যাডভোকেট শেখ কামাল, আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম, আজিজুল হক, মোস্তফা আনোয়ার, সাবেক এমপি আশেক উল্লাহ রফিকের ফুপাতো ভাই শমসের উল্লাহসহ আরও অনেকে।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, এই মামলায় প্রকৃত প্রভাবশালীদের অনেকেই বাদ পড়েছেন। মামলাটি যেন লোক-দেখানো আইনি পদক্ষেপ হয়ে না যায় সেই শঙ্কা রয়েই গেছে।
স্থানীয় জনসাধারণ ও পরিবেশ-সচেতন মহলের কণ্ঠে একই সুর- এই মামলায় প্রকৃত গডফাদাররা নিরাপদ।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, "যদি সত্যিকারের তদন্ত হয়, তাহলে দেখা যাবে যারা বাদ পড়েছে তারাই এই চিংড়িঘের সিন্ডিকেটের মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু তারা এমন উচ্চপর্যায়ের ছায়ায় রয়েছে, যেখানে প্রশাসনের হাত পৌঁছায় না।"
এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় জনমনের প্রশ্ন- “আইন কি কেবল দুর্বলদের জন্য? পরিবেশ রক্ষা আইন কি ক্ষমতাবানদের ক্ষেত্রে অকার্যকর?” এই মামলার ভবিষ্যৎ কি হবে, তা সময় বলবে। তবে একটি কথা স্পষ্ট, প্যারাবনের আগুন যেমন গাছপালা পুড়িয়েছে, তেমনি বিশ্বাসও পুড়িয়েছে- নির্বিকার প্রশাসনিক নীরবতায়।
প্রধান আসামি আলমগির চৌধুরি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, “সোনাদিয়ায় আমার কোনো জমি নেই, কোনো চিংড়িঘের নেই। মূল দখলবাজদের আড়াল করতে আমাকে টার্গেট করা হয়েছে।”
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, “প্যারাবন দখলের রাজনীতি মহেশখালীতে ওপেন সিক্রেট! দলে দলে নেতারা এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত, মামলা হলেও রক্ষা পেয়ে যায় বড় মাথারা।”
জানা গেছে, বর্তমানে সোনাদিয়া দ্বীপে চিংড়িঘেরের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৪টি। সরকারি হিসেবে আগে থেকেই ৩৭টি ঘের ছিল, এখন যুক্ত হয়েছে আরও ৭টি। অথচ পরিবেশ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও এ ঘেরগুলো উচ্ছেদে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. জমির উদ্দিন বলেন, “বিষয়টি আমরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। দ্রুত তদন্ত শেষ করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তিনি আশ্বাস দেন, প্রভাবশালী হলেও দোষী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
যেখানে জীববৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য ছিল একসময়, সেখানে এখন গাছ নেই, পশুপাখি নেই, কেবলই বাঁধ আর ঘেরের শাসন। মামলা হয়েছে, প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু পেছনের সেই ‘অদৃশ্য হাতগুলো’ এখনও অধরাই রয়ে গেছে। এমন অভিমত সচেতন মহলের।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর