
যারা লুটপাটের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, তাদের সংযুক্ত ও অবরুদ্ধ করা টাকা এবং শেয়ার ব্যবস্থাপনায় একটি আলাদা তহবিল গঠন করছে সরকার। লুটপাটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে ওই তহবিল থেকে টাকা দেওয়া হবে। এ টাকা আমানতকারীদের ফেরত দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি ব্যাংকের বাইরে থেকে অবৈধ উপায়ে যারা অর্থ লুট করেছেন-এমন অর্থ দরিদ্র জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হবে।
সোমবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট-বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান এএফএম শাহীনুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। এর আগে সকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ বিষয়ে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার অগ্রগতি পর্যালোচনা হয়।
যারা দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছেন, তারা শান্তিতে থাকতে পারবেন না, এ বক্তব্য প্রসঙ্গে গভর্নরকে প্রশ্ন করা হয়, আসলে কি তারা শান্তিতে নেই? এর জবাবে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, তারা শান্তিতে আছেন, তা বিশ্বাস করি না। তারা বড় বড় আইনজীবী নিয়োগ দিচ্ছেন। আমরা শুনেছি, এস আলম তার আইনজীবীর পেছনে বছরে তিন কোটি ডলার ব্যয় করবেন। এটা তার শান্তিতে থাকার লক্ষণ নয়। টাকা ফেরত আনতে পারা ও শান্তিতে থাকা দুটি ভিন্ন বিষয়। আমরা ঘুম নষ্ট করতে পেরেছি। টাকা ফেরত আনতে সময় লাগবে। কারণ, আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এটা এগোবে।
দেশের বড় ১০টি ব্যবসায়ী গ্রুপ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের বিরুদ্ধে ওঠা অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের আওতাধীন ১১টি টিম। এ সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য বৈঠকে তুলে ধরা হয়। শেখ হাসিনার পরিবারের বাইরে যে ১০টি শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো, নাবিল, সামিট, ওরিয়ন, জেমকন, নাসা, সিকদার ও আরামিট।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, এ সরকারই প্রথমবারের মতো এ ধরনের একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, জব্দ করা অর্থ ও সম্পদ এরই মধ্যে সরকারের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই এ তহবিলের কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে। প্রয়োজনে আইনে পরিবর্তন আনা হবে। ব্যাংকের টাকা ব্যাংককে ফেরত দেওয়া হবে। অন্য খাত থেকে যেসব অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে, তা জনহিতকর কাজে ব্যয় করা হবে।
গভর্নর বলেন, ব্যাংকে যে অর্থ আমানত হিসাবে জমা আছে, তা সহজেই পাওয়া পাবে। ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে এস আলম গ্রুপের ১২ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার শেয়ার জব্দ করা হয়েছে। এই শেয়ার একটি স্ট্র্যাটেজিক বিনিয়োগকারীর কাছে হস্তান্তর করা হবে। সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংক পাবে, যা আমানতকারীদের ফেরত দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হবে।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, টাকা কীভাবে ফেরত আনতে হয়, সেটার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল এক্সপেরিয়েন্সটা জানি। সাধারণত এটি করতে ৪ থেকে ৫ বছর সময় লাগে। কিন্তু এর মধ্যে ইমিডিয়েট কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বিদেশে তাদের যে সম্পদ আছে, সেটাকে ফ্রিজ করা যায়। সেটা আপেক্ষিকভাবে বছর খানেকের মধ্যে করা সম্ভব। প্রথমে দেশে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে, তারপর সঠিক পদ্ধতিতে বিদেশে রিকোয়েস্ট করতে হবে। যেটাকে বলা হয় মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স (এমএলএ)। এখন এ প্রক্রিয়ায় আছি। রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছি। গভর্নর বলেন, পাচার করা টাকা যে বাংলাদেশ থেকে গেছে, তা প্রমাণ করতে পারলে তাদের নাগরিকত্বও বাতিল হতে পারে।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, তারা শান্তিতে যে নেই, এর আরও একটা প্রতিচ্ছবি হলো-মাঝারি আকারের আরও ১২৫টি অনিয়ম তদন্তের আওতায় আসছে, যারা ২০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ লুট করেছেন। আমরা ২০টি বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছি। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কী কাজ হবে, তার কার্যপরিধি ঠিক করা হচ্ছে।
তিনি জানান, শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের পাশাপাশি ১০টি শিল্পগোষ্ঠীর ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার অর্থ অ্যাটাচমেন্ট আছে। ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার (দেশীয় মুদ্রায় ২০০০ কোটি টাকা) এবং ৪২ হাজার ৬১৪ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পত্তি স্থিতি (ফ্রিজিং) অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া বিদেশে ২৫৩ কোটির (২ কোটি ৭ লাখ ডলার) অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ আছে। এই অর্থ থেকে একটি ‘লুটের টাকা ব্যবস্থাপনা তহবিল’ গঠন করা হবে, যা সরকারের ব্যবস্থাপনায় থাকবে।
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর