
মানিকগঞ্জে ১৩ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে গ্রাম্য সালিশে অভিযুক্ত সামসুল হককে (৫৫) শারীরিক হেনস্তা ও লাখ টাকা জরিমানা করে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা।
এ ঘটনার পর নির্দিষ্ট সময়ে জরিমানার টাকা না দিয়ে বরং ভুক্তভোগী পরিবারকে ভয়-ভীতি দেখায় অভিযুক্ত শামসুল হক ও তার পরিবার। এ বিষয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী পরিবার।
অভিযুক্ত কিশোরী মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার আটিগ্রাম ইউনিয়নে খালার বাড়িতে মায়ের সাথে বেড়াতে এসেছেন মাস দুয়েক হয়। কিশোরগঞ্জ জেলার এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম তার। বাবা রাজধানীতে রিকশা চালান। পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতায় ও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপড়েনে মেয়েকে নিয়ে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন মা।
চলতি মাসের ১২ তারিখ (সোমবার) দুপুরে পার্শ্ববর্তী বাড়ির সম্পর্কে দাদা ফাঁকা বাড়িতে কিশোরীকে একা পেয়ে পান বানানোর কথা বলে ঘরে নিয়ে যান। পরে সেখানে কিশোরীর সাথে অপ্রীতিকর সম্পর্কে জড়ানোর চেষ্টা করেন সেই দাদা। একপর্যায়ে কিশোরী কান্না করলে অভিযুক্ত দাদা সেখান থেকে পালিয়ে যান। পরে বিষয়টি পরিবারকে জানান ওই কিশোরী। ঘটনা আশপাশে জানাজানি হলে সামাজিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেন স্থানীয়রা।
এর ফলশ্রুতিতে আটিগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মৃত আব্দুল হাকিম লর্ডের ছেলে সোহেল রানা (৪০) এবং বাদল ফকির (৫০) গ্রাম পুলিশ সাখাওয়াত হোসেনের (৪৮) সহযোগিতায় অভিযুক্ত শামসুল হককে পরদিন (১৩ মে) সালিশ বসবে জানিয়ে উপস্থিত হতে বলেন।
পরদিন রাত সাড়ে নয়টায় সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলে সোহেল রানের বাড়িতে ধর্ষণ চেষ্টা ঘটনা নিয়ে সালিশি বসে। এই সালিশে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি মনোনীত করা হয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা সালাম ফকিরকে (৭০)। এসময় সোহেল রানা (৪০), বাদল ফকির (৫০), মুশতাক আহমেদ (৪০), শফিকুল ইসলাম টুলু (৬০), গ্রাম পুলিশ সাখাওয়াত হোসেন (৪৮), নিয়ন খাঁ (৫৫), আব্দুস সামাদ (৫০), মো. ইউনুস (৫৫) সহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, সাড়ে নয়টায় শুরু হওয়া সালিশি চলে রাত দেড়টা পর্যন্ত। এ সময় অভিযুক্ত সামসুল হক তার দায় স্বীকার করলে তাকে শারীরিক হেনস্তা এবং ১ লাখ টাকা জরিমানা করা। জরিমানার টাকা সাত দিনের মাথায় পরিশোধ করতে হবে বলে সেখানে সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় অভিযুক্তের স্ত্রী এবং মেয়ে উপস্থিত ছিলেন।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রাম্য সালিশে মেনে নেওয়া রায় অভিযুক্ত এবং তার পরিবার মেনে গেলেও পরবর্তীতে ভুক্তভোগী পরিবারকে ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদান করেননি। বরঞ্চ ভুক্তভোগী পরিবারকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং এলাকা ছাড়া করার হুমকি প্রদান করে আসছে।
এ সকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে ভুক্তভোগী সামসুল হকের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। কথা হয় তার ছোট মেয়ে অঞ্জনা বেগমের (২৫) সাথে তিনি বলেন, 'তুচ্ছ একটা ঘটনাকে এলাকার কিছু অসাধু লোক টাকা খাওয়ার জন্য অন্যদিকে প্রবাহিত করেছে। আমরা শুরুতে বলেছিলাম ধর্ষণ হয়ে থাকলে মেডিকেল টেস্ট করা হোক। তারা সেগুলো করতে না দিয়ে সামাজিকভাবে বসে আমার বয়স্ক বাবাকে শারীরিক হেনস্তা করেছে।
আমার বাবা এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। তারা আমার বাবাকে কোন শারীরিক হেনস্তা করবে না বলে বিচারে হাজির করেছে। এর জন্য আমি সোহেলকে চল্লিশ হাজার টাকা সালিশে বসার আগেই দিয়েছি। তারা আমার বাবাকে সালিশে সবার সামনে হেনস্তা করল আবার জরিমানা দিতে বলল এক লাখ টাকা। আগে যে আমি ৪০ হাজার টাকা দিলাম ওই টাকা তাহলে কি হইল। এই ঘটনা নিয়েতো সামাজিকভাবে বসার কিছু নাই তাদের কাছে ঘটনা সত্য মনে হইলে থানায় অভিযোগ করতে পারত। এর বেশি আমি এখন কিছু বলতে চাচ্ছি না।'
অভিযুক্তের মামা অনেক মাহমুদ (২২) বলেন, 'এলাকার মাতব্বরেরা বসে বিষয়টা সমাধান করেছে। সালিশে তারা সব মেনে নিলেও এরপর থেকে আমাদেরকে (ভুক্তভোগী পরিবারকে) ভয়-ভীতি প্রদর্শন করছে। বলছে জরিমানার এক লাখ টাকা পারলে উঠাইয়া নিস। আর তোদের খবর আছে দেইখা নিব। এরপর থেকে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমরা এর সঠিক সমাধান চাই।'
স্পর্শকাতর ঘটনায় কেন সামাজিকভাবে মীমাংসার চেষ্টা করা হলো জানতে চাইলে সালিশেরে সভাপতি ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা সালাম ফকির বলেন, 'সালিশ বসার পর আমাকে সালিশে ডাকা হয়। আমি গিয়ে শুনলাম ওই মেয়েকে (ভুক্তভোগী কিশোরী) সামসুল জড়িয়ে ধরেছে পরে লোকজন মিলে এক লাখ টাকায় মীমাংসার রায় দিল এর আগে কে যেন সামসুলকে একটা চড় মারে। জরিমানার এক লাখ টাকা এক সপ্তাহের মধ্যে দেওয়ার কথা ছিল পরে কি হয়েছে আমি আর জানি না।'
তিনি জানান, তার আওয়ামী লীগের কোনো পদ নেই। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল না। এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম আমান উল্লাহ বলেন, 'ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা সামাজিকভাবে সুরাহার বিধান নেই।
ভুক্তভোগী পরিবার একটি অভিযোগ দিয়েছে আমরা অভিযোগ তদন্ত করছি। আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।'
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর