
পবিত্র ঈদুল আজহা আসন্ন। এই সময়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানি করে থাকেন। কোরবানির পশু কেনার সময় সুস্থ ও ভালো পশু নির্বাচন করা জরুরি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও ইন্টার ডিসিপ্লিনারি ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটির পরিচালক এবং ভেটেরিনারি ডক্টরস এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ- ভ্যাবের প্রেসিডেন্ট ড. মো. মাহবুব আলম কোরবানির পশু নির্বাচন থেকে শুরু করে কোরবানির পরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
পশু পরিবহনকালে অনেক সময় অমানবিকতার চিত্র দেখা যায়। এ বিষয়ে অধ্যাপক মাহবুব আলম বলেন, "গাদাগাদি করে পশু পরিবহন করলে স্ট্রেসের কারণে কর্টিসল, অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণ হয়, যা গ্লাইকোজেন ক্ষয় করে মাংস শক্ত করে তোলে। তাই স্ট্রেসমুক্ত পরিবহন নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যাতে পশুর মাংসের গুণমান অক্ষুণ্ণ থাকে।"
পশু কল্যাণ আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে তিনি জানান, বাংলাদেশে পশু পরিবহনের সময় পশু কল্যাণ আইন লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা জরিমানা এবং ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। নির্যাতনের মাত্রা বেশি হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিষ্ঠুরতা গুরুতর হলে জরিমানাসহ সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
সুস্থ পশু নির্বাচনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে অধ্যাপক মাহবুব আলম বলেন, "সুস্থ পশু সচল, চঞ্চল, জাবর কাটে, নাক ও মাজল ভেজা থাকে, পিঠের কুঁজ মোটা ও চামড়া টানটান থাকে। চোখ উজ্জ্বল, খাদ্যে আগ্রহী ও স্বাভাবিকভাবে মলমূত্র ত্যাগ করে। অসুস্থ পশু দুর্বল, নিস্তেজ, কম খায়, মুখ দিয়ে লালা পড়ে এবং কান নিচের দিকে ঝুলে থাকে।"
স্টেরয়েড খাওয়ানো গরু চেনার উপায় হিসেবে তিনি বলেন, "স্টেরয়েড প্রয়োগে গরু শান্ত থাকে, হাঁপায়, ক্লান্ত দেখায় এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে চাপ দিলে দেবে যায়। চকচকে চামড়ার গরু ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়ে থাকতে পারে। এ ধরনের গরুর উরুতে অতিরিক্ত মাংস দেখা যায় এবং শরীরে চাপ দিলে দেবে যায়।" এছাড়াও তিনি দেশি গরু কেনার পরামর্শ দেন, কারণ বিদেশি গরুর সঙ্গে সংক্রামক রোগ আসার ঝুঁকি থাকে।
পশুর শারীরিক গঠন, ত্বক, চোখ বা ক্ষুর দেখে রোগ নির্ণয় সম্পর্কে তিনি বলেন, "শরীরের গঠন, হাঁটার ভঙ্গি দেখে হাড় বা পেশির সমস্যার ধারণা পাওয়া যায়। চর্মরোগ যেমন চুলকানি, ছত্রাক সংক্রমণ বা অ্যালার্জির সমস্যা চামড়ার কিছু অংশ ঘষে নির্ণয় করা যায়। গরুর চামড়ায় গুটির মতো ফোলা ফোলা ছোট ছোট গোটা দেখে এলএসডি রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। ক্ষুরের অস্বাভাবিকতা, যেমন খুব মোটা ও বাঁকা হওয়া শরীরের ভেতরের কোনো রোগের লক্ষণ হতে পারে। চোখের রোগ যেমন লালচে চোখ বা কর্নিয়ার ক্ষত দেখে বোঝা যায়।"
দাঁত ও শিং দেখে বয়স নির্ধারণ কতটা নির্ভরযোগ্য, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "দাঁতের মাধ্যমে বয়স নির্ধারণের প্রচলিত নিয়ম থাকলেও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হলো খামারের রেকর্ড। সাধারণভাবে দাঁতের পরিবর্তন ও শিংয়ের রিং গণনা করে আনুমানিক বয়স নির্ধারণ করা যায়।"
গরুকে মোটাতাজা করতে ব্রয়লারের ফিড খাওয়ানো ক্ষতিকর কিনা, এ বিষয়ে তিনি বলেন, "গরুকে ব্রয়লার ফিড খাওয়ানো মারাত্মক বিপজ্জনক। এই ফিডের কারণে গরুর চামড়ার নিচে পানি জমে, যা জবাই করার পর চুপসে যায় এবং ওজনও কম হয়। মুরগি ও গরুর হজম প্রক্রিয়া ভিন্ন হওয়ায় গরু এই ফিড হজম করতে পারে না, ফলে কিডনি, লিভার, ফুসফুসে পানি জমে এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ব্রয়লার ফিডে থাকা উচ্চ প্রোটিন, এনার্জি ও স্টার্চ গরুর দেহে অতিরিক্ত তাপ, চর্বি ও মেটাবলিক হিট তৈরি করে, যা হিটস্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও পেটের নানা সমস্যার কারণ হয়। এই ফিডে থাকা উপাদান গরুর মাংসের মানও নষ্ট করে।"
কোরবানির মৌসুমে পশুতে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "কোরবানির আগে টিকাদান, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রোগী পশুকে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। গণসচেতনতা ও ভেটেরিনারি টিম সক্রিয় রাখতে হবে।"
পশুর চামড়া ছাড়ানোর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন, "প্রথমে পশুটিকে পরিষ্কার সমতল মাটিতে চিত করে শোয়াতে হবে। চামড়া ছাড়ানোর ক্ষেত্রে ভোঁতা ছুরি ব্যবহার করা ভালো। পশু জবাই করার সময় আমরা পা বেধে রাখি। যত দ্রুত সম্ভব পায়ের বাঁধন খুলে দিতে হবে, এতে পশু বেশি নড়াচড়া করবে এবং রক্তের প্রবাহ ভালো হবে। এর মাধ্যমে মাংসের গুণগত মানও বজায় থাকবে এবং চামড়া ছাড়ানোও সহজ হবে।"
কোরবানির পর সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, "পশু জবাইয়ের আগে নির্ধারিত স্থানে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। নাড়ি-ভুঁড়ি, হাড় ও অন্যান্য অংশ ব্যবহার করে মাছের খাদ্য, সার ও ওষুধের কাঁচামাল তৈরি করা সম্ভব। এককভাবে না করে, সম্মিলিতভাবে কোরবানি করলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহজ হয়।"
কোরবানিতে নিযুক্তদের স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়ে অধ্যাপক মাহবুব আলম বলেন, "মাংস কাটাকাটি ও চামড়া ছাড়ানোর সময় গ্লাভস, মাস্ক, জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার জুতা ব্যবহার করতে হবে। কাজের আগে ও পরে সাবান ও হালকা গরম পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ও শরীর ধুতে হবে। হাঁচি-কাশি থেকে বিরত থাকা, দূরত্ব বজায় রাখা এবং ভিড় এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন তিনি।"
সর্বশেষ খবর
ক্যাম্পাস এর সর্বশেষ খবর