
গত বছরের ৪ আগস্ট। ৫ আগস্ট সারাদেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত হলেও কিশোরগঞ্জ মুক্ত হয় তার আগের দিনই—৪ আগস্ট। সেই ঐতিহাসিক দিনে ছাত্র-জনতার একদফা দাবির আন্দোলনে শহীদ হন কিশোরগঞ্জের সন্তান রুবেল আব্দুল্লাহ (৩৫)।
ওইদিন সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়ান রুবেল। কখনো পানির বোতল হাতে সঙ্গীদের তৃষ্ণা মেটান, আবার কখনো মিছিলে যোগ দিয়ে রাজপথ কাঁপাতে থাকেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঈশা খাঁ রোডে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের সমন্বিত বাহিনীর গুলিতে আহত হন তিনি। আহত অবস্থাতেও তিনি এক আহত আন্দোলনকারীকে কোলে করে হাসপাতালে পৌঁছে দেন। পরে সেখানেই মারা যান রুবেল।
শহীদ রুবেলের স্থায়ী ঠিকানা কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ হলেও থাকতেন জেলা শহরের নীলগঞ্জ রোডে। কালীবাড়ি মোড়ে ‘মক্কা মোটরস’ নামের একটি দোকানে পুরোনো মোটরসাইকেল বেচাকেনা করতেন।
রুবেলের স্ত্রী মাজেদা আক্তার একজন গৃহিণী। তাদের তিন সন্তান—বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস নুন (১০), দ্বিতীয় মেয়ে জান্নাতুল মাওয়া (৮) এবং ছোট ছেলে মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ, যার বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর।
প্রশাসন, পরিবার ও স্বজন সূত্রে জানা যায়, ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা একদফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ৪ আগস্ট সকাল থেকে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট দখলে নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। এর আগে সকালেই জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা। সাড়ে ১০টার দিকে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের চাচাতো ভাই সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাসা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এসে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। আন্দোলনকারীরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পালিয়ে গিয়ে টিটুর বাসায় আশ্রয় নেন।
এরপর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ অফিসে আগুন দেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে টিটুর বাসা থেকে আবারও আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। তখন আন্দোলনকারীরা টিটুর বাসায় হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই পুরো সময়জুড়েই রুবেল আব্দুল্লাহ আন্দোলনকারীদের পাশে ছিলেন—পানির বোতল হাতে, মিছিলের সামনে।
আহত অবস্থাতেও রুবেল একজন আহত আন্দোলনকারীকে কোলে করে কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
রুবেলের ছোট ভাই রফিকুল ইসলাম তোফায়েল জানান, সংঘর্ষের দিন রুবেল নিজের টাকায় পাঁচ ডজন বোতল পানি কিনে আন্দোলনকারীদের মাঝে বিতরণ করেছিলেন।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী আশরাফ আলী সোহান বলেন, “রুবেল ভাই ঢাকার মুগ্ধের মতোই ‘পানি! পানি!’ বলে সবার তৃষ্ণা মেটাচ্ছিলেন। গুলির স্প্লিন্টারে আহত হয়েও তিনি অন্যকে হাসপাতালে পৌঁছে দেন।”
আন্দোলনের প্রথম সারির নারী ছাত্রদল নেত্রী নুসরাত জাহান বলেন, ‘শহীদ রুবেল আব্দুল্লাহ ভাই তার স্ত্রী ও তিনটি ছোট ছোট সন্তান রেখে আমাদের মাঝ থেকে চলে গেছেন। এই পরিবার যেন একা না পড়ে, সেই চেষ্টা আমাদের থাকবে। আমরা ছাত্রদল পরিবার হিসেবে সবসময় তাদের পাশে থাকবো।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিশোরগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক হাফেজ ইকরাম হোসেন বলেন, ‘যারা সরাসরি আন্দোলনকারীদের গুলি করেছিলেন, তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই।’
তৎকালীন আন্দোলন সমন্বয়কারী এবং বর্তমানে গণঅধিকার পরিষদের কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অভি চৌধুরী বলেন, ‘সারাদেশ ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদমুক্ত হলেও কিশোরগঞ্জ হয়েছিল একদিন আগেই—৪ আগস্ট। কারণ সেদিন দল-মত নির্বিশেষে সবাই রাস্তায় নেমে এসেছিল একদফা বাস্তবায়নের দাবিতে।’
জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক রমজান আলী বলেন, ‘সারাদেশের মতো কিশোরগঞ্জেও আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন ১৮ জন শহীদ। আমরা জামায়াতের পক্ষ থেকে প্রতিটি শহীদ পরিবারকে দুই লক্ষ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দিয়েছি। পাশাপাশি আহতদের চিকিৎসার খোঁজখবরও আমরা নিচ্ছি।’
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর