
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আন্দোলন। ১৬ জুলাই ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের মুহুর্মুহু গুলির মুখে মুরাদপুরের মহাসড়ক ছাত্রদের খুনে রঞ্জিত হয়। ওই দিনই শহীদ হন ওয়াসিম আকরাম, ফয়সাল আহমেদ শান্ত, মো. ফারুক। চট্টগ্রামের এই শহীদেরা এই আন্দোলনকে হাসিনা পতনের দিকে নিয়ে যান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনকে গড়ে তুলেছে সর্বস্তরের মানুষের গণ আন্দোলনে। চট্টগ্রামের ষোলশহর দুই নম্বর গেইট এলাকা ছিল এই আন্দোলনের সূতিকাগার। পরে নিউ মার্কেট, টাইগারপাস, চেরাগী মোড়, লালখান বাজার, আন্দরকিল্লা এই আন্দোলনের পথরেখা হিসেবে কাজ করে৷ ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনকে গণ আন্দোলনে রূপ দিতে সক্ষম হয়।
চট্টগ্রামের সমন্বয়ক ও চবি শিক্ষার্থী খান তালাত মাহমুদ রাফির পুলিশের সামনে রংপুরের আবু সাঈদের মতোই চট্টগ্রামের আন্দোলনে স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়৷ সেখান থেকে প্রতিরোধের দাবানল বিস্তৃত হতে থাকে। মিছিলের সারি বড় হতে শুরু করে। সরকার পতন পর্যন্ত সারাদেশের সাথে তাল মিলিয়ে রাজপথে থাকে চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরা৷ আর ৫ আগস্ট বিকাল পর্যন্ত পুলিশের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দেয় তারা। একে একে শহীদ হয় ১৩ ছাত্র-জনতা।
তারা হলেন- চট্টগ্রাম কলেজের সম্মান শ্রেণির ছাত্র ও ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম, এমইএস কলেজের ছাত্রশিবির নেতা ফয়সাল আহমেদ শান্ত, আশেকান আউলিয়া ডিগ্রি কলেজের ছাত্র তানভীর ছিদ্দিকী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তারুয়া, ফরহাদ হোসেন, জুতার দোকানের কর্মচারি শহীদুল ইসলাম, রিকশাচালক জামাল উদ্দিন, কাঠমিস্ত্রী মো. ফারুক, দোকান কর্মচারি মাহিন হোসেন সাইমুন, কার্টন ফ্যাক্টরির কর্মচারি মো. আলম, শ্রমিক মো. ইউসুফ, কলেজ শিক্ষার্থী ইশমামুল হক ও শিক্ষার্থী ওমর বিন নুরুল আবছার।
চট্টগ্রামের এই ১৩ জনসহ হাজার হাজার ছাত্র-জনতার রক্তভেজা আন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের মাফিয়া সরকারের পতন হয়। জনরোষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এ আন্দোলনে গুলিবিদ্ধসহ গুরুতর আহত হয়ে এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী, জনতা। তাদের এখনো সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পুলিশ-ছাত্রলীগের গুলি, হামলা, গণগ্রেপ্তার, নির্যাতনের মাঝেও ছাত্র-জনতার রাজপথে টিকে থাকার সাহসী ভূমিকা জুলাইকে দিয়েছে আলাদা মর্যাদা। চট্টগ্রামের ১৩ ছাত্র-জনতা খুনের নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
জানা গেছে, ১ জুলাই ঢাকা থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গঠিত হয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে একইদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) বেলা ১১টায় প্রথমে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামেন সমাবেশ করে শিক্ষার্থীরা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেট এলাকায় সড়ক অবরোধ করে তারা। ওইদিন তারা কোটা সংস্কার এবং ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিসহ চার দফা দাবি তুলে ধরেন। এরপর ধাপে ধাপে চট্টগ্রাম শহরমুখী হতে থাকে চবি শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই আন্দোলন। ৩ জুলাই বেলা এগারোটায় চবি শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে মিছিল নিয়ে হাটহাজারী-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে। ৪ জুলাই সকাল সাড়ে দশটায় কোটা সংস্কারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে প্রায় পাঁচ’শ শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। ৬ জুলাই শিক্ষার্থীরা চবি ক্যাম্পাস ছেড়ে শহরে আন্দোলন শুরু করেন। ওইদিন তারা বিকেল পৌনে ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত চট্টগ্রামের ২ নম্বর গেট এলাকা অবরোধ করেন। ৮ জুলাই বিকাল চারটার দিকে রেলপথ অবরোধ করে চবি শিক্ষার্থীরা। এতে ঢাকা-কক্সবাজারগামী পর্যটন এক্সপ্রেস ট্রেন আটকা পড়ে। ওইদিনই কোটা সংস্কার আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফিকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। ৯ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে দুপুর ১২টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করা হয়। ১০ জুলাই কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে নগরের দেওয়ানহাট এলাকায় রেলপথ অবরোধ করেন চবি ও চবি অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফলে চট্টগ্রাম-ঢাকা ও চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একই দিন শিক্ষার্থীরা নগরের টাইগারপাস এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন। ১১ জুলাই আবারও টাইগারপাস এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশ সেখানে বাধা দেয়। এসময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরাও তাদের সাথে যোগ দেয়। এর আগে যোগ দিলেও ১১ জুলাই থেকে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয় এবং কলেজে কলেজে সমন্বয়কের দায়িত্ব পান অনেকে। ১১ জুলাই আন্দোলনের একপর্যায়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এতে দুই শিক্ষার্থী আহত হন।
১২ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকেল ৪টার শাটল ট্রেনে চড়ে ১৬ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম ষোলশহর স্টেশনে যান চবি শিক্ষার্থীরা। এরপর বিকাল ৫টার দিকে এক দফা দাবিতে আন্দোলনরত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে শিক্ষার্থীরা। সেদিন ২ নম্বর গেইট এলাকায় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেন। ১৪ জুলাই কোটা বৈষম্য নিরসন করে সংসদে আইন পাসের লক্ষ্যে জরুরি অধিবেশন আহ্বান ও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গণ-পদযাত্রা শুরু করে শিক্ষার্থীরা। এরপর গণপদযাত্রা করার পর খান তালাত মাহমুদ রাফি ও রাসেল আহমদের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন। এসময় চট্টগ্রামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও চবি অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন। সেদিন হাজারো শিক্ষার্থী বাইরে অবস্থান করে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল মারমুখী। সেদিন শিক্ষার্থীদের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল দুপুর ১টার দিকে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আব্দুল মালেক বরাবর এ স্মারকলিপি দেয়।
১৫ জুলাই চবিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিলে হামলা করে ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাসে প্রক্টরের অফিসের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের উত্তেজনার মধ্যে তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ হয়। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে প্রাঙ্গণে চবি শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সাবেক আইন সম্পাদক খালিদ হোসেনের নেতৃত্বে এ হামলা চালানো হয়। খান তালাত মাহমুদ রাফিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ধরে নিয়ে যান সেদিন। এই খবর শুনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট থেকে মিছিল নিয়ে প্রক্টর কার্যালয়ের দিকে যাওয়ার সময় মিছিলটি শহীদ মিনারের সামনে পৌঁছালে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে নিরীহ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেন। এতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মাহবুবুর রহমানের মাথা ফেটে যায়। ১৬ জুলাই কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভের ডাক দেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়করা। ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলস্টেশন থেকে বিক্ষোভের সিদ্ধান্ত হয়। ওইদিন হামলার পরিকল্পনা নিয়ে দুপুর ১টা থেকে ষোলশহর এলাকায় অবস্থান নেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা। তাদের হাতে ছিল দেশীয় ও বিদেশী অস্ত্র, লাঠিসোঁটা ও পাথর। কোটা আন্দোলনকারীরা ষোলশহরে অবস্থান নিতে না পেরে নগরীর মুরাদপুর এলাকায় জড়ো হন। ওই সময় যুবলীগ ক্যাডার হেলাল আকবর বাবর, জাফর, ফিরোজ ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালানো হয়। এতে চট্টগ্রাম কলেজ শিক্ষার্থী শহীদ ওয়াসিকম আকরাম, ফয়সাল আহমেদ শান্ত, মো. ফারুক। ১৬ জুলাই ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে আন্দোলনকারীদের তিনজনের মৃত্যুর পর ১৭ জুলা আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা পায়। আগের দিন নিহতদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় নগরীর লালদিঘী মাঠে। এতে বিপুল মানুষের উপস্থিতি হয়। ওইদিন চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার শুরু করা হয়। নগর ছাত্রদলের সদস্য সচিব শরিফুল ইসলাম তুহিনসহ একাধিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয় সেদিন। ১৬ জুলাই দিবাগত রাত ও ১৭ জুলাই চারটি মামলা দায়ের হয়। এতে আসামি করা হয় কয়েক হাজার ব্যক্তিকে। ১৭ জুলাই মধ্যরাত থেকে চট্টগ্রামে মোবাইল নেটওয়ার্ক কমে যায়। ওইদিন থেকে মোবাইল নেটওয়ার্ক দিয়ে ফেসবুক ও মেসেঞ্জার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এত শিক্ষার্থীরা তাদের নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে বিকল্প উপায়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দেয়। ওইদিনই জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে দেয় চবি প্রশাসন। ১৭ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ছাত্রী ও রাত ১০টার মধ্যে ছাত্রদের হলত্যাগের নির্দেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ১৭ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা সারা দেশে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মর্সূচি ঘোষণা করলে ১৮ জুলাই সকাল থেকেই নগরীর অন্যতম প্রধান প্রবেশমুখ শাহ আমানত সেতু এলাকায় জড়ো হতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। মুখোমুখি অবস্থান নেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। বেলা ১১টার দিকে শুরু হয় সংঘর্ষ। পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও ফাঁকা গুলি নিক্ষেপ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেন বাকলিয়া কলেজ এলাকায়। সেখানে সড়ক অবরোধ করে তারা। সেখানেও পুলিশে গিয়ে তাদের ধাওয়া দেয়। সেখান থেকে দুপুর ২টার দিকে আবার বহদ্দারহাট এলাকায় অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। সেখানে আগে থেকেই চাঁন্দগাও আবাসিক, মেয়র গলি, বাড়াইপাড়া এলাকায় অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বহদ্দারহাটে দুই পক্ষের মধ্যে চলে সংঘর্ষ। দুপুর আড়াইটার দিকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেয়। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে বাদুরতলা ও মুরাদপুর এলাকার দিকে চলে যান। সেখান থেকে বিকেল ৪টার দিকে আবারও বহদ্দারহাটের দিকে যান আন্দোলনকারীরা। এরপর শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘর্ষ। সেখানে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ছাত্রলীগ করা শুরু করে। ছাত্রলীগের গুলিতে চবি শিক্ষার্থী শহীদ মো. তানভীর আহমেদ ও শহীদ সায়মন নিহত হন। ১৮ জুলাই রাত ৮টার দিকে সারাদেশের মতো চট্টগ্রামের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় হাসিনা সরকার। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
১৯ জুলাই জুমার নামাজ শেষে নগরের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ থেকে মিছিল বের করে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। আন্দরকিল্লা, চেরাগি মোড়, জামালখান, কাজীর দেউড়ি হয়ে নিউমার্কেট এলাকায় মিছিল করেন তারা। ছুটির দিন হলেও পুরো চট্টগ্রামে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করে। মধ্যরাত থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়। কারফিউ চলাকালে মোড়ে মোড়ে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। ওইসময় কার্যত ঘরবন্দি হয়ে যায় নগরবাসী। কারফিউ চলাকালে সেনা টহলও শুরু হয়। এরপর ২৮ জুলাই কারফিউ ভেঙে শিক্ষার্থী ও জনতা মিছিল করে। ওই দিন বহদ্দারহাট এলাকায় আরাকান সড়ক ও চান্দাগাঁও থানা পর্যন্ত ছাত্রলীগ-যুবলীগের সাথে সংঘর্ষ ছড়িযে পড়ে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুইজন প্রাণ হারান। ২৯ জুলাই বিকালে চেরাগী পাহাড় ও আন্দরকিল্লা মোড়ে চট্টগ্রামে পুলিশের সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। নগরীর জামালখান এলাকার চেরাগি পাহাড় মোড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এ বিক্ষোভ করেন। বিকাল ৪টার দিকে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় জামালখান ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের নেতৃত্বে গুলি করা হয় ছাত্রজনতার উপর। ৩০ জুলাইও ছাত্রলী, যুবলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করে ছাত্রজনতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা উপেক্ষা করে নগরজুড়ে বিক্ষোভ কওে তারা। ৩১ জুলাই চট্টগ্রাম আদালতে মার্চ ফর জাস্টিস পালনের লক্ষ্যে জড়ে[া হয় ছাত্র-জনতা। চট্টগ্রামের আইনজীবীরা শিক্ষার্থীদের মানবঢাল হয়ে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করে। এমনকি তারা মিছিল করে নিউমার্কেটে শিক্ষার্থীদের পৌঁছে দেয়। ১-৫ আগস্ট সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। নগর পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। ৪ আগস্ট নগরের রাইফেল ক্লাব, আমতল, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা গুলি চালায় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে। এতে বহু হতাহত হয। বিশেষ করে আমতল, গোলামরসুল মার্কেট, ছোটপুল এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। বহু ছাত্র ছাদের উপর ও অলি-গলিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অপরদিকে নগরের লালখান বাজারে সেনাবাহিনীর সামনে অবস্থান নেয় ছাত্রছাত্রীরা। সেদিন কাজির দেউড়ি এলাকায় সেনাবাহিনী সবাইকে তল্লাশি করে।
এদিকে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর চট্টগ্রামে থানাগুলোতে ৬০টির অধিক মামলা হলেও তেমন কোন গ্রেপ্তার নেই। সাড়ে চার হাজার আ. লীগ কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলেও উল্লেযোগ্য কোনো নেতাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। প্রকাশ্যে অস্ত্রধারীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। চট্টগ্রামের সাবেক তিন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী (জাবেদ, নওফেল, হাছান, ওয়াসিকা) সাবেক সিটি মেয়র রেজাউল, আ জ ম নাছির, সাবেক এমপি বাচ্চু, হেলাল আকবর বাবর, নুরুল আজিম রনি, আরশেদুল আলম বাচ্চু, কাউন্সিলর নূর মোস্তফা টিনু, শৈবাল দাশ সুমন, এসরাল হকসহ বেশিরভাগ আওয়ামী লীগের নেতারা পালিয়ে গেছেন।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর