
আজ বাংলার সাহিত্য ও সাংবাদিকতা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, ভাষাসৈনিক, কথাসাহিত্যিক এবং প্রগতিশীল চিন্তার অনন্য পুরোধা আবু জাফর শামসুদ্দীনের ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৮ সালের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবন ছিল কর্ম ও সাধনার এক অনবদ্য সমন্বয়, যার আলোয় তিনি আলোকিত করে গেছেন বাঙালি সমাজ ও মননকে। তাঁর প্রয়াণ দিবসে জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করছে।
আবু জাফর শামসুদ্দীনের জন্ম ১৯১১ সালের ১২ মার্চ গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরসাদী ইউনিয়নের দক্ষিণবাগ গ্রামে। এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্ম নেওয়া এই কৃতি সন্তানের শিক্ষার সূচনা হয় স্থানীয় পাঠশালা ও মাদরাসায়। গ্রামীণ পরিমণ্ডল থেকে উঠে এসে তিনি ভর্তি হন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। এই শিক্ষাযাত্রা ছিল মূলত তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের এক বলিষ্ঠ ভিত্তিপ্রস্তর, যা তাঁকে মুক্তচিন্তা ও জ্ঞানের পথে ধাবিত করে।
কর্মজীবনের শুরুতে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগদান করলেও সৃজনশীল সত্তার তীব্র আহ্বান তাঁকে বেশিদিন সেখানে স্থির থাকতে দেয়নি। কলমের অমোঘ টানে তিনি সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ করেন এবং খুব দ্রুতই নিজের স্থান তৈরি করে নেন। তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত পত্রিকা 'আজাদ', 'ইত্তেফাক', 'পূর্বদেশ' এবং 'সংবাদ'-এ তিনি কাজ করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। তিনি কেবল একজন সাধারণ সংবাদকর্মী ছিলেন না; তাঁর ক্ষুরধার লেখনী, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও নির্ভীক মত প্রকাশের মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মত ও মননের এক নির্ভরযোগ্য দিকনির্দেশক। তাঁর কলাম ও সাহিত্য পাঠকের মনে গভীর রেখাপাত করত এবং রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যজীবনও ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। ১৯৪৭ সালে 'পরিত্যক্ত স্বামী' উপন্যাসের মাধ্যমে তাঁর সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই একটি মাত্র উপন্যাসের মধ্য দিয়েই তিনি পাঠক ও সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, জীবনী, ভ্রমণকাহিনি থেকে শুরু করে অনুবাদ পর্যন্ত সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর প্রতিটি লেখায় ফুটে উঠত সমাজের বাস্তব চিত্র, মানুষের সুখ-দুঃখ, সংগ্রাম এবং শোষণ-বঞ্চনার কথা। তাঁর রচনাশৈলী ছিল সাবলীল এবং বিষয়বস্তু ছিল জীবনঘনিষ্ঠ, যা তাঁকে সাধারণ পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলে।
আবু জাফর শামসুদ্দীন ছিলেন একজন আপাদমস্তক প্রগতিশীল মানুষ। তিনি লেখনীর মাধ্যমে সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও পশ্চাৎপদ চিন্তার বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। তাঁর জীবন ও কর্ম আগামী প্রজন্মের জন্য এক অফুরন্ত অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে আমরা এমন এক ব্যক্তিত্বকে স্মরণ করছি, যিনি তাঁর মেধা ও মনন দিয়ে বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং বাঙালি জাতিকে দেখিয়েছেন আলোর পথ।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর