• ঢাকা
  • ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
  • শেষ আপডেট ৭ মিনিট পূর্বে
জহুরুল ইসলাম
শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ২৮ আগস্ট, ২০২৫, ০৪:৪৪ দুপুর

শাহজাদপুরের তাঁত শিল্পে চরম সংকট, কর্মহীন ১.১২ লাখ শ্রমিক

ছবি: প্রতিনিধি, বিডি২৪লাইভ

উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ কাপড়ের হাট শাহজাদপুর। মোগল আমলে শুরু হওয়া তাঁতে কাপড় বুনন কালক্রমে শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শিল্প সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করে বৃহত্তর পাবনা জেলায় এবং এর কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিতি লাভ করে শাহজাদপুর। মোগল আমলে যাত্রা শুরু করা এই শিল্পের প্রসার ঘটতে ঘটতে একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকে কেবলমাত্র শাহজাদপুরেই হাতে চালিত তাঁতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৬২ হাজার। বিরাট এই সংখ্যার তাঁত বিপুল সংখ্যক তাঁত শ্রমিকের নির্ভরযোগ্য জীবিকার মাধ্যম হয়ে ওঠে। কিন্তু কালের বিবর্তনে বিশ্ব রাজনীতি এবং বাণিজ্যিক নানা কৌশলের মারপ্যাঁচে হারিয়ে যেতে বসেছে তাঁত শিল্প। শাহজাদপুরের পুরো অঞ্চল খুঁজে পাওয়ারলুম এবং হ্যান্ডলুম মিলিয়ে বড়জোর টিকে আছে ৫০ হাজার তাঁত। এর ফলে কর্ম হারিয়েছে অন্তত ১ লাখ ১২ হাজার তাঁত শ্রমিক।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতি বছরের এ সময়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে দেশের তাঁত শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে বিপুল পরিমাণ তাঁতের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছাসহ দেশীয় তাঁতবস্ত্র পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে রপ্তানি হতো। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (সাপটা চুক্তি) বাতিলসহ ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চলমান নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েন, স্থলপথে দেশীয় তাঁতবস্ত্র রপ্তানি বন্ধ, আমেরিকার প্রণয়নকৃত ৬০ শতাংশ ভারতীয় তাঁতবস্ত্রের ওপর শুল্ক আরোপের কু-প্রভাবসহ নানা কারণে দেশীয় তাঁতবস্ত্র ব্যবসা চরম সংকটের মুখোমুখি। তাঁতবস্ত্রের অন্যতম ভরা মৌসুম দুর্গোৎসব উপলক্ষে এবার উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ শাহজাদপুর কাপড়ের হাট থেকে ভারতে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ তাঁতবস্ত্র রপ্তানি না হওয়ায় সরাসরি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পে। ফলে দিনে দিনে বন্ধ হচ্ছে তাঁত, আর তাঁতি ও শ্রমিকরা হচ্ছে বেকার।

তাঁতিদের ভাষ্যমতে, ‘মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরেই শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রতি বছর দেশীয় তাঁতবস্ত্রের বৃহৎ চালান ভারতে রপ্তানি হয়ে আসছে। ওই তাঁতবস্ত্র বিক্রির ওপরই স্থানীয় তাঁতিরা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় এবার সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ায় ও কাপড়ের হাটে দেশীয় তাঁতবস্ত্রের বেচাকেনা মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প চরম সংকটে পড়েছে!’ শাহজাদপুর কাপড়ের হাট পরিদর্শনকালে দেশীয় তাঁতবস্ত্র উৎপাদনকারী তাঁতি ও মহাজনেরা জানান, প্রতি বছরের এ সময় কোটি কোটি টাকার তাঁতবস্ত্র ভারত, জার্মানি, ইতালি, ইংল্যান্ডসহ বহিঃর্বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হলেও মোট রপ্তানির ৪০ ভাগ তাঁতবস্ত্রই যায় পশ্চিম বাংলার উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, হুগলি, বর্ধমান, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার, হাওড়া ও হুগলিসহ বিভিন্ন জেলার ছোট-বড় নামিদামি শপিংমল ও বিপণী বিতানসহ ভারতের নানা প্রদেশে। নানা রং-বেরঙের বাহারি ডিজাইনের দেশি তাঁতের শাড়ির গুণগত মান ও বাজার দর ভারতীয় বস্ত্র বাজারের অনুকূলে থাকায় শারদীয় দুর্গাপূজায় দেশীয় তাঁতবস্ত্রের ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বিশেষত ভারতীয় নারীরা দেশীয় তাঁত কারখানায় তৈরি সিল্ক জামদানি, সুতি জামদানি, কাতান, সুতি কাতান, রাজশাহী সিল্ক, বেনারশী, চোষা, শেড, বর্ণিল সুতা, স্বর্ণলতা, কটন, ব্লক ও চুমকির কাজ করা শাড়ির ওপরই ঝুঁকে পড়েন। বিগত বছরগুলোতে ভারতীয় ব্যাপারী ও পাইকার একেকজন শাহজাদপুর কাপড়ের হাট থেকে এ সময় কমপক্ষে ২ হাজার জোড়া থেকে ১৫ হাজার জোড়া তাঁতের শাড়ি ক্রয় করলেও তাদের আগমনের সংখ্যা প্রায় না থাকার কারণে এবার দেশীয় তাঁতবস্ত্রের শতকরা ৭০ ভাগ বিক্রি কমে গেছে।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুসারে দিনে দিনে দেশের তাঁত শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে সিরাজগঞ্জ ও কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে শাহজাদপুর দেশব্যাপী ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। শাহজাদপুরের তালতলা, খঞ্জনদিয়ার, রামবাড়ি, পুকুরপাড়, মনিরামপুর, প্রাণনাথপুর, শক্তিপুর, শান্তিপুর, থানারঘাটপাড়া, আন্ধারকোঠাপাড়া, রূপপুর, রূপপুর নতুন পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, উড়ির চর, নগরডালা, ডায়া, হামলাকোলা, জামিরতা, কৈজুরী, খুকনী, জালালপুর, পোতাজিয়া, গাড়াদহসহ নানা স্থানে তাঁতের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ ৬২ হাজার। শ্রমিকের সংখ্যাও ছিল আনুপাতিক হারে সমান। কিন্তু, পরপর কয়েকবারের বন্যা, করোনাভাইরাস, হ্যান্ডলুমের স্থলে পাওয়ারলুমের প্রচলন, এবারে দুর্গাপূজায় ভারতে দেশীয় তাঁতবস্ত্রের একটি বৃহৎ অংশ রপ্তানি করতে না পারাসহ শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে বেচাকেনায় ধ্বসের কারণে প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। পুঁজি সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে লাখো তাঁত বলে শাহজাদপুর তাঁত শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আল মাহমুদ এ প্রতিবেদককে মুঠোফোনে নিশ্চিত করেছেন।

তাঁতিরা আরও জানান, শাহজাদপুর, বেলকুচি আর এনায়েতপুরে প্রতি সপ্তাহেই হাট বসে। শাহজাদপুরে রবি ও বুধবার; বেলকুচিতে মঙ্গল ও বুধবার এবং এনায়েতপুরে শুক্রবারে হাট বসে থাকে। লুঙ্গি আর থ্রি-পিসের জন্য বিখ্যাত বেলকুচির হাট। তবে শাহজাদপুরের হাটটিই এখন সবচেয়ে বড়। এসব হাটে প্রচুর দেশীয় শাড়ি ওঠে। পাইকার ছাড়াও সাধারণ গ্রাহক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সেখান থেকে শাড়ি কিনে থাকলেও বর্তমানে সকল হাটেই বেচাকেনায় নেমেছে ধ্বস। ফলে এলাকার লাখো তাঁতিরা পরিবার-পরিজনের জীবিকা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে! স্থানীয় তাঁতি মহাজনেরা জানান, ২০১০ সাল থেকে ভারতে রপ্তানি হচ্ছে শাহজাদপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার তাঁতের শাড়ি। ভারতে যায় ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা দামের শাড়ি। গত বছরগুলোর এ সময়ে সপ্তাহে কেবল শাহজাদপুর হাট থেকে কমপক্ষে ২০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার শাড়ি ভারতে রপ্তানি হতো; আর বেলকুচি হাটের সাপ্তাহিক টার্নওভার ছিল প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এই টার্নওভারের অন্তত: ৪০ শতাংশ আসে রপ্তানি থেকে। গত বছর পর্যন্ত এ চাহিদা ক্রমবর্ধমান থাকলেও এবারের চিত্র উল্টো। দেশীয় তাঁতবস্ত্র ব্যবসার ভরা মৌসুমেও উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে দেশীয় তাঁতবস্ত্রের বেচাকেনা না থাকায় তাঁতিরা প্রতিটি মুহূর্ত চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় পার করছেন।

শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে আগত উপজেলার গাড়াদহ নতুন পাড়ার শওকত আলীর ছেলে তাঁতবস্ত্র উৎপাদক ও বিক্রেতা মাসুদ রানা বলেন, ‘তার তাঁত কারখানার ৭/৮টি তাঁতে টাঙ্গাইলের কাতান শাড়ির ত্যানা দিয়েছিলেন। ১৭০০ টাকা পেটির (৪ পিছ) শাড়ি উৎপাদন করে হাটে আনলেও ক্রেতা না থাকায় বিক্রি করতে পারেননি।’ পৌর এলাকার তালতলা মহল্লার মৃত মজিবর রহমানের ছেলে উজ্জ্বল ও পার্শ্ববর্তী উল্লাপাড়া উপজেলার বালসাবাড়ী মধুপুর গ্রামের তাঁতি শফিকুল ব্যথিত চিত্তে জানালেন একই কথা! হাটে বেচাকেনা নেই। শ্রমিকদের কিভাবে বিল দেবেন? ঋণের কিস্তি কিভাবে পরিশোধ করবেন? পরিবারের ভরনপোষণই বা কিভাবে চলবে? ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প রক্ষায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কোনো বিকল্প নাই বলেও তারা উল্লেখ করেন। শাহজাদপুর কাপড়ের হাটের ইজারাদার মোঃ নাদিম আলী বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এবার ভারতে কিছুটা কম দেশীয় তাঁতবস্ত্র রপ্তানি হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, ঐতিহ্যবাহী এ পেশাটির সাথে জড়িত লাখ লাখ তাঁতিদের কথা মাথায় রেখে সংশ্লিষ্টরা ঐতিহ্যবাহী দেশীয় তাঁত শিল্প রক্ষায় দ্রুতই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।’

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড টেক্সটাইল এন্ড পাওয়ারলুম ইন্ড্রাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিএসটিএমপিআইএ) এর সহ-সভাপতি আবু হাসান খান মনি ও পরিচালক, কেন্দ্রীয় তাঁতি নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব হায়দার আলী বলেন, ‘দেশীয় তাঁতবস্ত্র ব্যবসার আরেক ভরা মৌসুম শারদীয় দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে স্থানীয় তাঁতিরা তাদের কারখানায় উৎপাদিত তাঁতের শাড়ি নানা কারণে ভারতে রপ্তানি করতে পারছেন না। বর্তমান সরকারের সাথে ভারত সরকারের চলমান নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ৩ মাস ধরে স্থল পথে ভারতে দেশীয় তাঁতবস্ত্র রপ্তানি বন্ধ, আমেরিকার প্রণয়নকৃত ৬০ শতাংশ ভারতীয় তাঁতবস্ত্রের ওপর শুল্ক আরোপের কু-প্রভাব ও শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে তাঁতবস্ত্র বেচাকেনায় ধ্বস নামায় ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প আবারও চরম সংকটে পড়েছে। এ চরম দুরবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারকেই দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে; তাহলেই ফের ঘুরে দাঁড়াতে পারবে দেশের সর্ববৃহৎ কুটির শিল্প ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প’ বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেন।

সালাউদ্দিন/সাএ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
পাঠকের মন্তব্য:

BD24LIVE.COM
bd24live.com is not only a online news portal. We are a family and work together for giving the better news around the world. We are here to give a nice and colorful media for Bangladesh and for the world. We are always going fast and get the live news from every each corner of the country. What ever the news we reached there and with our correspondents go there who are worked for bd24live.com.
BD24Live.com © ২০২০ | নিবন্ধন নং- ৩২
Developed by | EMPERORSOFT
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬০৩২০২৪৩৪
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬০৩১৫৭৭৪৪
ইমেইলঃ [email protected]