
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পশ্চিম প্রান্তে হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে প্রায়
৩০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ অবস্থিত। এই পাগলা মসজিদ মুসলিম-অমুসলিম
সকলের কাছেই একটি বিস্ময়। এর ইমরাত খুবই সুন্দর এবং নির্মাণশৈলীও বেশ চমৎকার।
তিন তলা বিশিষ্ট পাগলা মসজিদের ছাদে তিনটি বড় গম্বুজ এবং ৫ তলা ভবনের সমান
একটি মিনার বহুদূর থেকে সহজেই দৃষ্টি কাড়ে।
মূলত বিপুল পরিমাণ টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা ও সোনা রুপা দান হিসেবে পাবার জন্য এই
পাগলা মসজিদ সর্বাধিকআলোচিত।
এই মসজিদ সম্পর্কে শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) জুম্মার নামাজের বয়ানের সময় ৩ টি
পয়েন্ট তুলে কথা বলেন পাগলা মসজিদের খতিব মাওলানা আশরাফ আলী।
তিনি বয়ানে বলেন, ১ নাম্বর এই পাগলা মসজিদের সূচনাটা কেমনে হলো, ২ নাম্বার
পাগলা মসজিদ কেনো নাম হলো কখন থেকে হলো এবং ৩ নাম্বার এই মসজিদে মানুষের দান
করার প্রবনতাটা কবে থেকে হলো, কিভাবে হলো।
আশরাফ আলী আরো বলেন, এখন মোবাইলের যোগ। ফেসবুকের মাধ্যমে এই পাগলা মসজিদ নিয়ে
নানান কথা আসে, ভূয়া কথা বার্থা। এমনোও কথা যে এই নদী দিয়া এক বুজর্গ জায়নামাজ
বিছিয়ে পানি দিয়ে আইছে। এগুলো ভুয়া কথা।
তিনি আরো বলেন, এমনোও কথা আয়ে যে, 'শহীদ পাগলা', শহীদ পাগলা কে চিনেন। শহীদ
পাগলার মাধ্যমে নাকি এই মসজিদ হয়ছে। এই জন্য নাকি পাগলা মসজিদ। ১ নম্বর ১০০%
না ৫০০% মিথ্যা কথা। শহীদ পাগলা কবে, আমি ত দেখছি। আমি আসছি ত এই পাগলা মসজিদে
১৯৭৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। যা নাকি এখন আমার ৪৬ বছর অতিক্রম করে ৪৭ বছর হয়ছে।
আমি দেখছি শহীদ পাগলা মানুষের কাছ থেকে চান্দা করছে, টিন কালেকশন করে বিভিন্ন
জায়গায় দিসে কি দিসে না আল্লাহ জানে। পাগলা মসজিদে যে শহীদ পাগলা একটা কিছু
টিন দিসে এটা আমি জীবনেও দেখি নাই। আমার এই ৪৬ বছরের মধ্যে।
আশরাফ আলী আরো বলেন, এই সেপ্টেম্বর মাসে আমার ৪৬ বছর অতীত হয়ে গেলো, ৪৭ বছর
শুরু হয়ে গেলো। যদি আল্লাহ যতদিন রাখে। কাজেই এই সমস্ত কিছু না। তখন তো পাগলা
মসজিদ কেনো, তখনের অবস্থা অন্য রখম ছিলো। গুরুদয়াল কলেজের প্রফেসর জিয়া উদ্দিন
সাব আজ থেকে ৫০ বছর আগে উনি একটা লেখা দিসিলেন, যে আড়াইশ বছর আগে এই পাগলা
মসজিদের সূচনা শুরু হয়। এখন ৩০০ বছর আগে হলো এই পাগলা মসজিদের সূচনা। ৩শ বছর
এটা কি খুব বেশি মনে হয়। ৩শ বছর ১শ, ২শ, ৩শ। আমারিই বয়স এখন ৮০ চলছে। তে ৩শ
বছর কি। ৩শ বছর আগে এটার সূচনা। সূচনাটা কেমনে হলো এটা আমি বলতেছি। এটা একটা
ছোট্ট একটা টিলার মত ছিলো। হয়বত নগরের জমিদার বাড়ি। তাদের প্রপারট ছিলো। কথাটা
লক্ষ করেন। বাস্তব কথা এগুলি। আল্লাহ বোধয় এই কথা গুলো বলার জন্য আমাকে এখনো
বাঁচিয়ে রাখছে। কবে যেনো চলে যায় যানি না। এডা দেওয়ান বাড়ির অর্থাৎ হয়বত নগর
জমিদার বাড়ির প্রপাটি ছিলো। এই টিলাডা ছিলো সোয়ারি ঘাট। তারা এখানে আইসা নৌকায়
উইটা বিভিন্ন জায়গায় সাইর করতো। আগে ত নদী এমন ছিলো না। খরস্রোতা নদী ছিলো।
চতুর্দিকে পানি, স্রোত, আমি নিজে দেখিছি। ভাটি, এই মিঠামইন, ইটনা, অষ্টগ্রাম
সহ আরো যত হাওর আছে ভাটি এলাকায়। সেখান থেকেই ডাইরেক নৌকা নিয়া মহিলারা আসছে
পাগলা মসজিদে আবার নৌকা দিয়াই গেসে। এখন তো পানি নাই। আমাদের অফিসে কিছু
কাগজপত্র ছিলো। এখন আছে কি না জানিনা। এই কাগজপত্রে বুঝা যায় এই টিলার উপর
একটা মসজিদ নির্মাণ হলো। জমিদার ফ্যামিলির দুইজন মহিলা একটা ছোট্ট মসজিদ
দিলো। কেনো দিলো। এটারোও একটা কথা আছে। হয়বত নগর এখান থেকে বেশি দূরে না। তখন
তো এত মানুষের সমাগম ছিলো না। সেখান থেকে আযান শুনতো এই টিলার উপরে। তখন আযান
শুনে তারা আসতো এসে কোনো মানুষ পাইতো না। তখন তারা কি করলো, এখানে যে আযান হয়
মানুষ নাই, এই জায়গাটা আমাদের, আমরা এখানে একটা ছোট্ট মসজিদ দিয়ে দেয়। পরে
দেওয়ান বাড়ির তারা এখানে একটা ছোট্ট মসজিদ দিলো। তখন তো এত কিছু ছিলো না। এই
কোনার মধ্যে ছোট্ট একটা মসজিদ ছিলো। দেওয়ান বাড়ির তারা দিসে। এরপরে মসজিদ
আলহামদুলিল্লাহ হইলো, তখন ৩শ বছর আগে। যারা দিসে কাগজে পত্রতে নাম আসে দেওয়ান
আয়শা দাদ খান, আরেকটা নাম আছে দেওয়ান জিলকদর খান। তাদের আরেকটা প্রপার্টি ছিলো
শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ। দেওয়ান আয়শা দাদ খান আর জিলকদর খান জমিদার ফ্যামিলির
দিনদার ফ্যামিলি। আল্লাহ ওয়ালা ফ্যামিলি ছিলো। সেই শোলাকিয়া মাঠে প্রথম ছিলো
মাওলানা আতহার আলী (র:)। এই তারাই চিন্তা করে এই টিলার উপর ছোট্ট একটা মসজিদ
দিলো।
এখন পাগলা মসজিদ কেনো হলো, পাগলা কেমনে হলো এই বিষয়ে মাওলানা আশরাফ আলী আরো
বলেন, এই দেওয়ান আয়শা দাদ খান আর দেওয়ান জিলকদর খান, এই দুই মহিলাদেরকে সাধারণ
মানুষ পাগলা বিবি ডাকতো। কেনো ডাকতো। এরার আচার-আচরণ আল্লাহ ওয়ালা ছিলো। এই
কারণে সাধারণ মানুষ এই দুই মহিলাকে পাগলা বিবি বলতো। তারাই এই মসজিদ দিসে। বেস
কিছুদিন পর্যন্ত পাগলা বিবির মসজিদ বলে এটা প্রচলিত ছিলো। আর কত পাগলা বিবির
মসজিদ বলবে, শেষ পর্যন্ত বিবি নামটা আউট হয়ে গিয়ে শুধু পাগলা মসজিদ, পাগলা
মসজিদ। কথাটা বুঝছেন পাগলা মসজিদ নামটা কেমনে হলো।
তিনি আরো বলেন, এটা স্বাভাবিক। আমি তো ৪৬ বছর যাবত আছি। আমারে আমার বন্ধু
বান্ধব পাগলা ইমাম বলতো। আমার ছাত্ররা পাগলা হুজুর। বলতো আসলে পাগলা মসজিদের
ইমাম, পাগলা মসজিদের হুজুরের এটা দাও, ওটা দাও। ছাত্ররা। কিন্তু এত লাম্বা নাম
আর থাকলো না। সিদা পাগলা হুজুর আর পাগলা ইমাম আমিও মাইনা নিছি। আল্লাহ যদি
আমারে সত্যিকারে মাফ করে দেয়। আমারে যদি সেই মাফের পাল্লাত আল্লাহ পালাইয়া দেই
কোনো আপত্তি নাই। এই পাগলা বিবির মসজিদ এভাবেই পাগলা নাম হয়লো। কয় পাগলা
মসজিদের ইমাম সিদা পাগলা ইমাম যেমন আমারে কয়।
সর্বশেষ পাগলা মসজিদের দান করার যে প্রবনতাটা এটা কেমনে হলো। আগে তো এত মানুষ
আসতো না। আমিই তো ১৯৭৯ সালে আসছি পড়ে ৩০/৩৫/৪০ জন মানুষ নিয়ে জুম্মার নামাজ
পড়ছি। এই কোণায় একটা মসজিদ ছিলো। আর এই সমস্ত জায়গা ডুবা ছিলো, খেত ছিলো। তিন
চার ফুট নিচে। আর এহন তো বোধয় শতেক মানুষ হয় নাকি পাগলা মসজিদে জুম্মার মধ্যে।
পরে একজন উত্তর দিলো ২০ হাজার। পরে হুজুর বলেন ওরে বাবারে ০ বাইরে গেসেগা। সেই
যাই হোক। হয়বত নগর জমিদার বাড়ির লাস্ট জমিদার ছিলেন মান্নান দাদ খান। তিনি
আমার এক এক আত্মীয়র সাথে বলছেন এই পাগলা মসজিদ হওয়ার আগে তাদের ফ্যামিলির
লোকজন দেখলো হিন্দু প্রধান এলাকা ছিলো। আর এটা খরস্রোতা নদী। তো উনি বলতেছেন
হিন্দু লোকেরা আইসা ভোগ দেন নদীতে। স্বল্প মুসলমান ছিল তারাও আইসা হিন্দুদের
সাথে ভোগ দিতো মসজিদ নির্মাণের আগেই। উনি ইতিহাস টা বলছেন যার কাছে তিনি আমার
কাছে বলছেন। এই অচাতল ছিলো না, এখন ত পানি নাই। ১৯৮৮ সালে বন্যা হল ছোট মসজিদ।
আমার বাসা দুচালা একটা টিনের ঘরের মধ্যে ছিলো। ওই বন্যার সময় এত পানি হলো যে
ওই সময় বাসা থেকে মসজিদে বাঁশের সাকু দিয়ে আসছি মসজিদে।
মাওলানা আশরাফ আলী আরো বলেন, মন্নান দাদ খান বলছেন, এখানে মুসলমান যারা আছে,
স্বল্প মুসলমান তারা হিন্দুদের সাথে এসে ভোগ দেয়। তে মুসলমানরা যে দিবে কোনো
মসজিদ ভিত্তিক দিবে, হিন্দুদের সাথে কেনো দিবে। এইযে দেওয়ার প্রবনতাটা কিন্তু
তখন থেকেই মসজিদ।
তিনি আরো বলেন, মান্নান দাদ খান বলছেন যে এটা মসজিদ হওয়ার আগে গোটা কিছু
মুসলমান যারা ছিলো হিন্দুদের সাথে হিন্দুদের কথা অনুযায়ী ভোগ দিতো। তে এখন
উনারা চিন্তা করলো মুসলমানরা কিছু দিতে হলে মসজিদ ভিত্তিক দিবে। তাই তারা
এখানে তাদের টিলার উপর ছোট্ট একটা মসজিদ দিলো। এই মুসলমানরা এই মসজিদে দেয়।
এইযে দেওয়ার একটা প্রবনতা শুরু হলো এটা এখনোও আছে, এখনোও আছে, আমি দেখেছি
এখনোও আছে মানুষ দেয়। কারোর ফলে আবার কারোর না ফলে। এই রখম ত হয় নাই যে কেউ
আসে তারিই সব কিছু মনজুর হয়ে গেল।
তো এই মসজিদে দেওয়ার যে একটা প্রবনতা এটা তখন থেকেই ছিলো। ক্রমে ক্রমে বাড়তে
বাড়তে এখন ত হাজার হাজার না, লক্ষ লক্ষ না, কোটি কোটি টাকা এই মসজিদে আসে তাই
না। কাজেই এই মসজিদ সম্পর্কে তিনটা বাস্তব কথা বললাম।
তিনি আরো বলেন, বিশেষ ভাবে যখন করোনা আসলো করোনার পরে মিডিয়া সাংবাদিকরা এটা
আরো প্রচার করে করে এটা আরো বাড়াইছে। এখন মানুষ পাগলা মসজিদের দিকে আসে। নতুবা
হাদিসের ভাষা অনুযায়ী মক্কার কাবা শরীফের যে হারাম শরীফ, মদীনার হারাম শরীফ আর
বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদে আকসা ফিলিস্তিনের সহ শত শত নবীর এলাকার যে মসজিদ ছিলো
এই কয়টা মসজিদ ছাড়া আকাশচুম্বী মসজিদ হোক বা টিনের ঘর বা ছনের ঘরের মসজিদ হোক
মর্যাদা একিই। এটা হলো বাস্তব কথা। এখন পাগলা মসজিদে কেনো এত মানুষ আসে এটা
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জানেন আমি ত জানিনা।
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর