
কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে স্বৈরাচারী দোসরদের প্রভাব এখনো সক্রিয় বলে অভিযোগ উঠেছে। সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. জামাল নাছের ও সাবেক সচিব অধ্যাপক নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ৪০ জনকে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগকারীরা বলছেন, নিয়োগপ্রাপ্তরা এখনো সাবেক কর্মকর্তাদের নির্দেশেই কাজ করে চলেছেন। এসব অভিযোগ বোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, যা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
এদিকে, সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. জামাল নাছের ও সাবেক সচিব অধ্যাপক নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই তদন্তের অংশ হিসেবে বোর্ডের আরও ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ১৬ ও ১৭ মার্চ দুদকের কুমিল্লা কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এদের বিরুদ্ধেও সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেলে অনুসন্ধান শুরু হতে পারে।
যে ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বক্তব্য শোনা হবে তারা হলেন: উপসচিব (প্রশাসন) এ কে এম সাহাবুদ্দিন, উপসচিব (একাডেমিক) মো. সাফায়েত মিয়া, সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. মো. আসাদুজ্জামান, সাবেক উপপরিচালক (হিসাব ও নিরীক্ষা) মোহাম্মদ ছানাউল্লাহ, সাবেক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. গোলাম হোসেন, সাবেক উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (মাধ্যমিক) মো. শহিদুল ইসলাম, সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট (কম্পিউটার শাখা) বিকাশ চন্দ্র মল্লিক, নিরাপত্তা কর্মকর্তা কেয়া রায়, দারোয়ান মো. আক্তার হোসেন ও ঠিকাদারী কর্মচারী মো. সজিব। এদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধেই দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। দুদকের সমন্বিত কুমিল্লা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. তারিকুর রহমান এই ১০ জনকে হাজির হতে অনুরোধ জানিয়েছেন।
বোর্ড সূত্রে জানা যায়, সাবেক সচিব অধ্যাপক মো. নূর মোহাম্মদ ১৪ বছর ধরে বোর্ডে কর্মরত ছিলেন এবং প্রথমে উপসচিব ও পরে সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর তাকে নোয়াখালী সরকারি কলেজে বদলি করা হয়। প্রেষণে কর্মকর্তার তিন বছরের বেশি থাকার নিয়ম না থাকলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাড়ি হওয়ায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের তদবিরে তিনি দীর্ঘ সময় কুমিল্লায় অবস্থান করেন বলে অভিযোগ।
অধ্যাপক মো. জামাল নাছের চাকরির শেষ দুই বছর বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং এখান থেকেই অবসরে যান। তিনি এর আগেও বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক ছিলেন। চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের পর ২০২৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ৪১টি শূন্য পদে লোক নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন, যার মধ্যে প্রোগ্রামার, সহকারী প্রোগ্রামার, উপসহকারী প্রকৌশলী, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, মসজিদের ইমামসহ বিভিন্ন পদ ছিল। অভিযোগ উঠেছে, জামাল নাছের তার শ্বশুরবাড়ির মাহমুদুল হাসান ও মাজহারুল ইসলামকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেন। অবসরে যাওয়ার আগের দিন তড়িঘড়ি করে ৩৯টি পদে নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয় বলে অভিযোগ, যেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপিদের সুপারিশ ছিল এবং অবৈধ লেনদেনও সংঘটিত হয়। পোষ্য কোটা ১০ ভাগ থাকলেও কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি, যা চাকরিজীবীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। নিয়োগে বয়স সঠিকভাবে মানা হয়নি বলেও অভিযোগ।
মসজিদের ইমাম পদে চেয়ারম্যানের শ্বশুরবাড়ি কিশোরগঞ্জ এলাকার একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিবন্ধী কোটায় যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার প্রতিবন্ধিতা বোঝা যায় না বলে অভিযোগ। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আনসার-ভিডিপি সদস্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা আগে প্রশিক্ষণ না নিয়েই সার্টিফিকেট জমা দিয়েছেন।
বোর্ডের সাবেক সচিব প্রফেসর নূর মোহাম্মদ নিজ জেলার প্রতিবন্ধী কোটায় অফিস সহকারী হিসেবে ইমরান হোসেনকে নিয়োগ দেন বলে অভিযোগ, যদিও ইমরান হোসেন প্রতিবন্ধী নন এবং তার চাকরির বয়সও পেরিয়ে গেছে। নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. আসাদুজ্জামান তার নিজ উপজেলা দেবিদ্বারের শাকিল আহমেদকে অফিস সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। জাবিবুল ইউসুফ সাবরীর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকলেও সাবেক মন্ত্রী দীপু ও চাঁদপুর জেলার পুরান বাজার কলেজের অধ্যক্ষ রতন কুমারের সুপারিশে তাকে দুই মাস পর নিয়োগ দেওয়া হয়। উপপরিচালক (হিসাব ও নিরীক্ষা) ও নিয়োগ কমিটির সদস্য মো. সানাউল্লাহ তার নিজ জেলা নোয়াখালীর হাতিয়ার সাব্বির হোসেনকে অফিস সহকারী পদে নিয়োগ দেন। উপ-সচিব (প্রশাসন) ও নিয়োগ কমিটির সদস্য একেএম সাহাব উদ্দিন সোহাগ চন্দ্র দাস ও শামীম হোসেনসহ দুইজনকে অফিস সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। উপ-কলেজ পরিদর্শক ও নিয়োগ কমিটির সদস্য বিজন কুমার চক্রবর্তী বিপ্লব শেখকে গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ দেন, যেখানে অষ্টম শ্রেণি পাশ চাওয়া হলেও তিনি আইএস পাশ ছিলেন। কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর জহিরুল ইসলাম পাটোয়ারী নিজ উপজেলা চৌদ্দগ্রামের জাকির হোসেনকে ইলেকট্রনিক্স পদে নিয়োগ দেন। উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও নিয়োগ কমিটির সদস্য শহিদুল ইসলাম চন্দ্র মজুমদার ও কেয়া রায়সহ প্রায় ৪০ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেন।
অভিযোগ রয়েছে, এই ৪০ জনের নিয়োগপত্র পুলিশ তদন্তের কাগজপত্র ডাকযোগে আসার নিয়ম থাকলেও তারা নিজেরাই হাতে হাতে এসব কাগজপত্র নিয়ে আসেন। নিয়োগের পূর্বে প্রত্যেক নিয়োগপ্রাপ্তদের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা থেকে শুরু করে প্রায় ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে নিয়োগ প্রদান করা হয়। নিয়োগ পাওয়ার পর এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সাবেক চেয়ারম্যান, সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, উপসচিবসহ তাদের যোগসাজশে এখনো অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের নির্দেশমতো কাজ করছেন।
আলমগীর হোসেন ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য আবির হোসেন সম্প্রতি কুমিল্লা দুর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে এই ৪০ জন অবৈধ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একটি অভিযোগ প্রেরণ করেন। অভিযোগের পরও কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. সামছুল ইসলাম ও সচিব প্রফেসর মোহাম্মদ খন্দকার সাদেকুর রহমান কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে, যা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান জামাল নাছের বলেন, "যেসব অভিযোগ উঠেছে তা ভিত্তিহীন ও হাস্যকর। জনবল সংকটে নিয়মিত কাজে সমস্যা হতো। অনেক দৌড়াদৌড়ি করে বোর্ডের কাজে গতিশীলতা আনতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করি। এটা এক ধরনের হয়রানি ছাড়া আর কিছুই নয়।" সাবেক সচিব নূর মোহাম্মদ বলেন, "সুনামের সঙ্গে চাকরি করেছি। দুর্নীতি করিনি। কিছু লোক ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ ছাড়াই এসব মিথ্যা অভিযোগ করেছে।"
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর