
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় গবাদিপশুর মধ্যে ছড়িয়ে পড়া অ্যানথ্রাক্স (তড়কা) রোগ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। খামারিদের মধ্যে ক্ষতির দুঃস্বপ্ন দেখা দিয়েছে। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে সরকার নির্ধারিত ৮০ পয়সার ভ্যাকসিন ২০ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একদল অসাধু চক্র অসহায় খামারিদের ভয়ের সুযোগ নিয়ে দিনভর মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছে, অথচ রোগ নিয়ন্ত্রণে কোনো নিশ্চয়তা নেই।
কে বা কারা এই টিকার বাণিজ্য পরিচালনা করছে, কার আশীর্বাদে মাঠে এমন অবাধ লুটপাট চলছে, প্রশাসনের চোখের সামনে কীভাবে ৮০ পয়সার ভ্যাকসিনে অর্ধকোটি টাকার বাজার গড়ে উঠছে— এ প্রশ্ন এখন পুরো সুন্দরগঞ্জে ঘুরপাক খাচ্ছে।
খামারিদের অভিযোগ, গত কয়েক দিনে অ্যানথ্রাক্স মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত শতাধিক গবাদিপশু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এই সুযোগে প্রাণিসম্পদ দপ্তরের লোকজন ভ্যাকসিনের সরকারি দামের চেয়ে ২০-৩০ টাকা বেশি নিচ্ছেন। দুর্যোগের সময় সেবার পরিবর্তে টাকা লুটে নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ খামারিদের। জানা গেছে, পার্শ্ববর্তী রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলা ঘেঁষে সুন্দরগঞ্জ। পীরগাছায় তড়কা রোগে এ পর্যন্ত ২ জন মারা গেছেন এবং ৭ জন ব্যক্তি আক্রান্ত আছেন। এ রোগের জীবাণু অসুস্থ গবাদিপশুর মাংস থেকে ছড়ায়।
পীরগাছা উপজেলা ঘেঁষা সুন্দরগঞ্জেও এ পর্যন্ত শতাধিক গরু মারা গেছে। প্রতিনিয়ত আক্রান্ত গরু জবাই করা হচ্ছে। এসব গরুর মাংস খেয়ে প্রায় অর্ধশত লোক অসুস্থ হয়েছেন। এ সংক্রান্ত সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। গবাদিপশুগুলোকে ভ্যাকসিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত জরুরি এক বৈঠকে গৃহীত হয়। সেই থেকে অ্যানথ্রাক্স রোগ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন কার্যক্রম চলছে। এতে বিভিন্ন কৌশল ও হয়রানির ভয় দেখিয়ে ৮০ পয়সার ভ্যাকসিন ২০-৩০ টাকায় নেওয়া হচ্ছে। সচেতনতায় কোনো প্রচারণা না থাকায় এখনো ৯০ শতাংশ গবাদিপশু ভ্যাকসিনের বাইরে আছে। এ উপজেলার প্রায় আড়াই লাখ গবাদিপশুর মধ্যে প্রায় ২ লাখ গবাদিপশু ভ্যাকসিন পাবে। তাতে ভ্যাকসিন কার্যক্রমে জড়িতরা অর্ধ কোটিরও বেশি টাকা লুটে নেবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে তাদের মানবিক হওয়ার দাবি জানিয়েছেন পশুমালিকরা।
এদিকে, আড়াই লাখ গবাদিপশুর বিপরীতে ভ্যাকসিন এসেছে মাত্র ২৬ হাজার ৪০০। এর মধ্যে ২২ হাজার গবাদিপশু ভ্যাকসিনের আওতায় এসেছে। অবশিষ্ট ৪ হাজার দিয়ে ভ্যাকসিন কার্যক্রম চলমান রেখেছে প্রাণিসম্পদ দপ্তর। তবে, নতুন করে আরও ৫০ হাজার ভ্যাকসিন চেয়ে আবেদন পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আড়াই লাখ গবাদিপশুর বিপরীতে মাত্র ২৬ হাজার ভ্যাকসিন বরাদ্দ হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খামারিরা।
বামনডাঙ্গার দিনমজুর আজহার মিয়া জানান, তার ৪টি গরু এবং ২টি ছাগল আছে। প্রাণিসম্পদ দপ্তরের দুইজন এসে তড়কার ভ্যাকসিন নেওয়ার কথা বলেন। দাম জানতে চাইলে তারা ২০ টাকা দাবি করেন। তিনি কম নিতে বললেও তারা ২০ টাকা নেওয়ার কথা জানান এবং প্রাণিসম্পদ অফিসে গেলে আরও বেশি লাগবে বলে জানান। তখন আর তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না বলেও জানান। তিনি বাধ্য হয়ে ২০ টাকা করে দিয়েছেন।
মনমথ গ্রামের ভ্যান চালক মজিবর রহমান বলেন, “এটে তো সবাই বসি আছি। ওমরা মটর সাইকোল নিয়া আসিয়া কয় ভ্যাকসিন নেও গরুর। কনু বলে কতো করি নেন। তকন কয় বিশ টেকা করি নেই। দশ টেকা করি দিবার চাইনো তাক কয় না। বাজারোত ফুরি আইনো ম্যালা গরু। বিশ টেকা করি ওমরা সবাই দিছে। পরে ২০ ট্যাকা দিয়া একটা গরুর টিকা নিছোম।”
সোনারায় ইউনিয়নের পূর্ব সোনারায় গ্রামের মো. রফিক মিয়া বলেন, 'আমি শুনলাম গরুর নতুন একটা রোগ ছড়াইছে। হামার বাড়িত ৫টা গরু আছে। এখন টিকা কই আছে, কী ভাবে পাওয়া যাবে কিছুই জানি না।'
খামারি সেজে ভ্যাকসিনেটর চন্দন কুমার রায়ের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘পশু প্রতি ২০ টাকা করে নিচ্ছি। আর এ টাকা আমাদের অফিসে জমা দিতে হয়।’ ভ্যাকসিনের দাম ৮০ পয়সা সরকারি নির্ধারিত হলেও কেন বেশি নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন- “আমাদের অফিসের আনুষঙ্গিক কিছু খরচ আছে সেগুলো এখান থেকে তুলতে হবে।”
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ বিপ্লব কুমার দে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আনুষঙ্গিক কিছু খরচ থাকায় ১০ টাকা করে নিতে বলা হয়েছে। এর বেশি নিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো গবাদিপশুর মালিককে ভয় দেখিয়ে নয় বরং কেউ টাকা দিতে অক্ষম হলেও তাকে ভ্যাকসিন দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া আছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজ কুমার বিশ্বাস প্রতি ভ্যাকসিন ৮০ পয়সা এই বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, 'ভ্যাকসিন প্রতি কতো টাকা নেওয়া যাবে, বিষয়টি প্রাণিসম্পদ ভালো বলতে পারবে। তবে আমি যতটুকু জানি তাতে টিকা প্রতি ১০ টাকা করে নিচ্ছেন তারা। তবে এটা তাদের সিদ্ধান্ত, এখানে আমাদের বলার কিছু নাই বলেও জানান উপজেলা নির্বাহী অফিসার।'
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর