ঔপনিবেশিক শৃংখলমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা জুলাই বিপ্লবের অন্যতম দাবী এই শিরোনামে শিক্ষাবিষয়ক জাতীয় সেমিনারে বক্তারা জুলাই বিপ্লবের পূর্ণতা দিতে এবং এর স্পিরিট সমাজে বাস্তবায়ন করতে হলে ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার অপরিহার্য, এমন মন্তব্য করেছেন।
তাঁদের মতে, বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামো এখনও ঔপনিবেশিক চিন্তা ও দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠন ও বিশ্বের বুকে মর্যাদার সঙ্গে দাঁড়াতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত ও দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। তবে দুঃখজনকভাবে জুলাই বিপ্লবের পর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে একাধিক কমিশন গঠন হলেও শিক্ষা সংস্কার বিষয়ক কোনো কমিশন গঠিত হয়নি, যা সরকারের একটি ব্যর্থতা বলে তাঁরা মন্তব্য করেন।
৯ অক্টোবর ২০২৫ (বৃহস্পতিবার) বিকেল ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন হলে “ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা: স্বরূপ, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা – প্রেক্ষিত বাংলাদেশ ২.০” শীর্ষক জাতীয় সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে ঢাকা ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড থটস (আরআইটি), বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব কম্প্যারেটিভ স্টাডিজ, শিক্ষা অধিকার সংসদ এবং ইউনিভার্সিটি স্ট্যাডি ফোরাম।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. তারেক মোহাম্মদ জায়েদ, রিসার্চ ফেলো, আইএনটিআই ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়া। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামো এখনও মেকলের শিক্ষা নীতির উত্তরাধিকার বহন করছে, যেখানে শিক্ষাকে আত্মপরিচয়ের চেয়ে চাকরিমুখী করে তোলা হয়েছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত স্বাধীনভাবে চিন্তা ও সৃষ্টিশীলতা বিকাশের সুযোগ তৈরি করা।”
তিনি আরো বলেন, “শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য ইন্টারভেনশন দরকার, ম্যাক্রো, মেসো ও মাইক্রো- এই তিন স্তরে সংস্কার জরুরি। সরকারিভাবে ফ্লেক্সিবল কারিকুলাম প্রণয়ন, শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, শ্রেণিকক্ষ পর্যায়ে নৈতিকতা ও মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে গুরুত্ব দিতে হবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “ভূমি, শ্রম, পুঁজি ও সংগঠনের পাশাপাশি উন্নয়নের পঞ্চম স্তম্ভ হলো নৈতিকতা। শিক্ষা ব্যবস্থায় cognitive, affective এবং psychomotor- এই তিন ডোমেইনের সমন্বয় ঘটাতে হবে।” সভাপতির বক্তব্যে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাঈল বলেন, “শিক্ষা কেবল পেশা বা কর্মসংস্থান নয়, এটি চিন্তার মুক্তি, মানবিকতা ও ন্যায়বোধ গঠনের প্রক্রিয়া। মুক্ত সমাজ গড়তে হলে শিক্ষার আত্মা উপনিবেশমুক্ত হতে হবে।”
প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন প্রফেসর ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া, সদস্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি; অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; ড. খ ম কবিরুল ইসলাম, সাবেক সিনিয়র সচিব; প্রফেসর ড. নাজমুন নাহার, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি; নুরুল ইসলাম সাদ্দাম, সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির; মুহাম্মদ রায়হান আলী, সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস; আবু সাদিক কায়েম, সহ-সভাপতি, ডাকসু; মাজহারুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক, জাকসু; এবং মো. বুরহান উদ্দিন নোমান, নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব ইনোভেশন ইন পলিসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইপিডি)।
বক্তারা বলেন, উপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে চিন্তা ও মূল্যবোধের দাসত্বে আবদ্ধ করেছে। প্যানেল আলোচক জনাব মোশাররফ হোসেন বলেন, “ব্রিটিশদের তৈরি শিক্ষা ব্যবস্থা এই দেশে এক কোটিরও বেশি শিক্ষিত বেকার তৈরি করেছে- এর দায় রাষ্ট্রের শিক্ষানীতির ব্যর্থতা।”
মুহাম্মদ রায়হান আলী বলেন, “যে শিক্ষাব্যবস্থা ভঙ্গুর ও নৈতিকতাহীন, সেই শিক্ষায় দক্ষ ও সৎ নাগরিক তৈরি হয় না। শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে এবং প্রযুক্তিনির্ভর কর্মমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।”
প্রফেসর ড. নাজমুন নাহার বলেন, “আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু গুণগতমান কমছে। শিক্ষকদের সততা ও নৈতিকতার অভাব শিক্ষার্থীদের মননেও প্রভাব ফেলছে। উন্নয়নমুখী ও মানবিক শিক্ষা ছাড়া সামাজিক রূপান্তর
অসম্ভব।”
মো. বুরহান উদ্দিন নোমান বলেন, “ব্রিটিশদের পূর্বে সুলতানি ও মুঘল আমলে শিক্ষা ছিল সমাজকেন্দ্রিক ও মানবিক ঔপনিবেশিক শিক্ষা সেই কাঠামো ভেঙে দেয়- এর ফলে তৈরি হয় লার্নিং লস ও সাংগঠনিক স্থবিরতা।”
বক্তারা আরও বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের মতো শিক্ষা সংস্কারেও একটি জাতীয় কমিশন গঠন করা জরুরি। তারা সতর্ক করে বলেন, যদি শিক্ষা সংস্কার বিলম্বিত হয়, তবে উপনিবেশিক কাঠামোই সমাজ ও রাষ্ট্রের মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকবে।
সেমিনারে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বক্তাদের অভিমত- “শিক্ষা যদি মুক্ত না হয়, সমাজও মুক্ত হতে পারে না।”
আয়োজক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় আগামী মাসগুলোতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আঞ্চলিক সেমিনার ও গবেষণা প্রকাশনার আয়োজন করা হবে।
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর