এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল করেছে কক্সবাজার জেলায়। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় জেলার পাসের হার নেমে এসেছে মাত্র ৪৫ দশমিক ৩৯ শতাংশে। প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য। শিক্ষার মান, শিক্ষক সংকট ও শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহ- সব মিলিয়ে উপকূলের শিক্ষায় জ্বলছে লাল বাতি।
অভিভাবকদের অভিযোগ, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকেই শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা থেকে মনোযোগ হারাতে শুরু করে। সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা ইস্যুতে আন্দোলন, মানববন্ধন, কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ায় ক্লাসে উপস্থিতি কমে যায়। অনেকে দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত পাঠে ফেরেনি। শিক্ষকদের ভাষ্য, এই অনাগ্রহই এখন ফলাফলে প্রতিফলিত হয়েছে- পরীক্ষায় প্রশ্ন সহজ হলেও প্রস্তুতি ছিল না বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর কক্সবাজারে মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ১২ হাজার ৮৪৩ জন। এর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয় ১২ হাজার ৬৯৮ জন, পাস করেছে ৫ হাজার ৭৬৩ জন, ফেল করেছে ৬ হাজার ৯৩৫ জন।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, জেলার প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম পাসের হার।
ছেলে পরীক্ষার্থী ছিলেন ৫ হাজার ১৬২ জন, পাস করেছেন ২ হাজার ১৮৭ জন- পাসের হার ৪২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অন্যদিকে মেয়েদের সংখ্যা ৭ হাজার ৫৩৬ জন; পাস করেছে ৩ হাজার ৫৭৬ জন, পাসের হার ৪৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সাফল্য প্রায় ৫ শতাংশ বেশি।
জেলায় মোট ২০৬ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে- এর মধ্যে ছেলে ৬৭ জন, মেয়ে ১৩৯ জন।
কলেজভিত্তিক ফলাফলে দেখা যায়, সরকারি কলেজগুলো এখনো কিছুটা সুনাম টিকিয়ে রেখেছে। কক্সবাজার সরকারি কলেজের পাসের হার ৮২ দশমিক ৯৯ শতাংশ- ১ হাজার ২০৫ জনের মধ্যে পাস করেছে ১ হাজার জন। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৬১ জন। রামু ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে পাসের হার ৯৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ, কুতুবদিয়া সরকারি কলেজে ৮২ দশমিক ৪৮ শতাংশ, আর মইনুদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজে ৮২ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
কিন্তু বেসরকারি কলেজগুলোর চিত্র ভয়াবহ। কক্সবাজার কমার্স কলেজে পাসের হার মাত্র ১৯ দশমিক ৮২ শতাংশ, উখিয়া কলেজে ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ, চকরিয়া সরকারি কলেজে ৩০ দশমিক ৭৩ শতাংশ, আর চকরিয়া কমার্স কলেজে একজনও পাস করেনি- পুরো কলেজে পাসের হার শূন্য।
বিভাগভিত্তিক ফলাফলে দেখা যায়, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মানবিক বিভাগে। এ বিভাগে পাসের হার মাত্র ৩৯ দশমিক ০১ শতাংশ। বিজ্ঞান বিভাগে তুলনামূলক ভালো ফল- ৬৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ, আর ব্যবসায় শিক্ষায় ৪৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
মানবিক বিভাগে অংশ নেয় ৮ হাজার ৪৬ জন শিক্ষার্থী; এর মধ্যে ৩ হাজার ১৩৯ জন পাস করেছে। ছেলেদের পাসের হার ৩৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ, মেয়েদের ৪১ দশমিক ১৯ শতাংশ। বিজ্ঞান বিভাগে অংশ নেয় ১ হাজার ৭৩০ জন, পাস করেছে ১ হাজার ১৭৬ জন। ব্যবসায় শিক্ষায় অংশ নেয় ২ হাজার ৯২২ জন, পাস করেছে ১ হাজার ৪৪৮ জন। জিপিএ- ৫ প্রাপ্তদের মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে ৯০ জন, মানবিকে ৬৩ জন, এবং ব্যবসায় শিক্ষায় ৫৩ জন।
মহিউদ্দিন নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা গত আগস্টের পর থেকে পড়াশোনার চেয়ে রাজনীতি আর সামাজিক ইস্যুতেই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে। কলেজে ক্লাস হয়েছে খুবই কম, আবার অনেকে দিন-দুপুরে মিছিল-মিটিংয়ে গেছে। এখন তার ফল মিলেছে রেজাল্টে।’
আবুল হাশেম নামের এক শিক্ষক বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। অনেকেই সিলেবাস শেষ করতে পারেনি, আবার পরীক্ষার আগে ঠিকভাবে প্রস্তুতও নেয়নি। ফলাফল খারাপ হওয়া খুব স্বাভাবিক- এটা আসলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি সতর্ক সংকেত।’
গত এক দশকের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, কক্সবাজারের শিক্ষার মান ক্রমেই নিম্নমুখী। ২০২৩ সালে পাসের হার ছিল ৭০ দশমিক ৩৮ শতাংশ, ২০২২ সালে ৭৪ দশমিক ৯২ শতাংশ, ২০২১ সালে ৮৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৫৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ, আর ২০১৬ সালে ৬৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।
এবারের ৪৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ পাসের হার শুধু সাম্প্রতিক সময় নয়, পুরো এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে কম।
কক্সবাজার সরকারি কলেজ ৮২.৯৯ কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজ ৭৬.৫৮, ডিসি কলেজ ৭৪.৭১, কুতুবদিয়া সরকারি কলেজ ৮২.৪৮, রামু ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ ৯৩.৭৫, টেকনাফ সরকারি কলেজ ৩৩.৯০, উখিয়া কলেজ ২০.৪০, মহেশখালী কলেজ ২৯.৬৮, বদরখালী কলেজ ২৪.২৮, চকরিয়া কমার্স কলেজ ০.০০, চকরিয়া সরকারি কলেজ ৩০.৭৩, শহীদ জিয়াউর রহমান উপকূলীয় কলেজ ৬২.০২।
পরীক্ষায় অকৃতকার্য এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘অনলাইনে ক্লাস কম হয়েছে, অনেক বিষয় ঠিকমতো বোঝা যায়নি। পরীক্ষার প্রশ্নও তুলনামূলক কঠিন ছিল।’
অন্যদিকে কক্সবাজার সরকারি কলেজের এক সফল শিক্ষার্থী বলেন, ‘পরিশ্রম করলে ভালো ফল হয়। আমরা নিয়মিত পড়েছি বলেই কলেজের সুনাম ধরে রাখতে পেরেছি।’
অভিভাবকদের অভিযোগ, অনেক কলেজে নিয়মিত ক্লাস হয় না। উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষক সংকট তীব্র।
নজিবুল আলম নামের একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক বলেন, ‘মানবিক বিভাগে ফল খারাপের মূল কারণ ইংরেজি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে দুর্বলতা। শিক্ষার্থীরা পুরো সিলেবাস শেষ করতে পারেনি।’
শিক্ষাবিষয়ক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, কক্সবাজারে সরকারি ও বেসরকারি কলেজের শিক্ষার মানে বড় ফারাক তৈরি হয়েছে। সরকারি কলেজে শিক্ষার পরিবেশ ও তদারকি তুলনামূলক ভালো হলেও, বেসরকারি কলেজগুলোতে ক্লাসরুম সংকট, শিক্ষকের ঘাটতি এবং ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে দিচ্ছে।
তাদের মতে, শুধু পরীক্ষা নয়, এটি পুরো শিক্ষাব্যবস্থার স্থবিরতার প্রতিচ্ছবি। দীর্ঘদিন ধরে জেলার শিক্ষার মান উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প ও উদ্যোগ নেওয়া হলেও মাঠপর্যায়ে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষক নিয়োগে ধীরগতি, শ্রেণিকক্ষের সীমাবদ্ধতা, আর শিক্ষার্থীদের আগ্রহহীনতা মিলিয়ে কক্সবাজারের শিক্ষাব্যবস্থা এক গভীর সংকটে পড়েছে। একসময় যে জেলার কলেজগুলো চট্টগ্রাম বোর্ডে সেরা দশে থাকত, আজ সেই কক্সবাজারেই ফেল শিক্ষার্থীর সংখ্যা অর্ধেকের বেশি।
দশকের ব্যবধানে কক্সবাজারের শিক্ষা যে তলানিতে নেমেছে, এবারের ফলাফল তারই প্রমাণ। শিক্ষাবিদদের মতে, এখনই সঠিক পদক্ষেপ না নিলে আগামী বছর আরও ভয়াবহ চিত্র দেখা যেতে পারে।
তাদের মতে, এটা কেবল খারাপ ফল নয়, উপকূলের শিক্ষার মানে জ্বলছে লাল বাতি।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেনি। অনেক কলেজে শিক্ষকের অভাব, শ্রেণিকক্ষের অনিয়ম এবং পাঠদানের মান কমে যাওয়ায় এ ফলাফল হয়েছে। আগামী বছর পরিস্থিতি পাল্টাতে শিক্ষা প্রশাসন আরও সক্রিয় ভূমিকা নেবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইংরেজিসহ কয়েকটি বিষয়ে খারাপ ফলের কারণে সামগ্রিক পাসের হার ব্যাপকভাবে কমেছে।’
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর