রাজবাড়ীর আলোচিত নুরুল হক মোল্লা ওরফে নুরাল পাগলার (৮৫) লাশ কবর থেকে তুলে পোড়ানো এবং দরবারে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার দুই মাস পর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, জামায়াত, বিএনপি, আওয়ামী লীগ, এনসিপি নেতা, মসজিদের ইমাম ও সাংবাদিকসহ ৯৬ জনের নাম উল্লেখ করে ৫ শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) রাজবাড়ী আদালতে মামলাটি দায়ের করেন নুরাল পাগলের স্ত্রীর বড় বোন শিরিনা (৫২)। বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামদিজ হোসেন মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য পিবিআইকে আদেশ দিয়েছেন।
মামলার বিষয়ে বাদীর আইনজীবী এডভোকেট শরিফুল ইসলাম জানান, মামলায় ৯৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও অজ্ঞাত পরিচয় আসামি করা হয়েছে আরও ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে। চলতি বছরের ২২শে ডিসেম্বরের মধ্যে মামলাটি তদন্ত করে পিবিআইকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সরকারি গোয়ালন্দ কামরুল ইসলাম কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ খন্দকার আবদুল মুহিতকে। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন- গোয়ালন্দ উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমীর মোঃ জালাল উদ্দিন প্রামাণিক, উপজেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও ইমান আকিদা রক্ষা কমিটির সদস্য-সচিব আইয়ুব আলী খান, উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি গোলাম মাহাবুব রাব্বানী, আল জামিয়া নিজামিয়া আরাবিয়া কওমি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আমিনুল ইসলাম কাশেমী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুল আলীম, গোয়ালন্দ মডেল মসজিদের ইমাম মুফতি আজম, বড় মসজিদের ইমাম হাফেজ আবু সাঈদ (কারাগারে আছেন), জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গোয়ালন্দ উপজেলা শাখা সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী রাকিব হাসান ও যুগ্ম সমন্বয়কারী নাজমুল ইসলাম এবং ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী মকিম মন্ডল প্রমুখ।
মামলার বিবরণে বাদী উল্লেখ করেন, গত ২৩শে আগস্ট গোয়ালন্দ পাক দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগল মৃত্যুবরণ করলে তাকে তার মৃত্যুপূর্ব ইচ্ছা অনুযায়ী দরবার শরীফে সমাহিত করা হয়। কিন্তু উল্লিখিত আসামিরাসহ অজ্ঞাতনামা কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল পূর্ব পরিকল্পিতভাবে দফায় দফায় রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দসহ বিভিন্ন জায়গায় সমবেত হয়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সভায় মিলিত হয়ে নুরাল পাগলের সমাধিকে ঘিরে নানা প্রশ্ন উত্থাপন করে উদ্দেশ্যেমূলকভাবে সংস্কারের দাবী তোলে। এক পর্যায়ে আসামিদের হুমকি ধামকিতে ভীত হয়ে বাদী পক্ষ দরবারের পক্ষ থেকে তা মেনে নিয়ে শর্তসমূহ পূরণ পূর্বক তা যথাসময়ে অর্থাৎ গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে লিখিত ও বাচনিক আকারে অবহিত করে। কিন্তু গত ৫ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজের পর দুপুর ৩টার দিকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে গোয়ালন্দ পাক দরবার শরীফকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র, লাঠিসোঁটা নিয়ে দুর্বৃত্তরা দরবারের মূল ফটক ও পূর্ব-দক্ষিণ পাশের সীমানা প্রাচীর আংশিক ভেঙ্গে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে প্রথমেই নুরাল পাগলের সমাধিতে ব্যাপক ভাঙচুর ও তান্ডবলীলা চালায়। এ সময় দরবার শরীফের অভ্যন্তরে দরবারের একনিষ্ঠ খাদেম মোঃ রাসেল মোল্লা (২৭) কে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে। সেই সাথে দরবারে থাকা আরও শতাধিক মুরিদকে তারা পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করে এবং বহু ব্যক্তির মাথা, শরীর ও পা থেঁতলে দেয়। পরে দুর্বৃত্তরা নুরাল পাগলের আবাসিক ভবন, হুজরা খানা ও দরবারে অবস্থিত অন্যান্য স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করে এবং নুরাল পাগলের কুলখানির জন্য ভক্ত আশেকানদের সংগৃহীত নগদ ৩০ লক্ষ টাকা ও নুরাল পাগলের দরবার থেকে একশত ভরি স্বর্ণালংকার লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়।
এছাড়াও দরবারের ভক্তদের ব্যবহৃত ৮টি বড় ফ্রিজ, ৪৩টি সিসি ক্যামেরা, ৮টি মনিটর, ২টি পানির মোটর পাম্প, আশেকানদের ব্যবহৃত ১১টি মোটর সাইকেল, ১২৮টি বাটন ও স্মার্ট মোবাইল, একটি গরু, চাল-ডাল ও সাংসারিক যাবতীয় সামগ্রী আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ভয়-ভীতি ও মারধর করে লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। এতে প্রায় ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতি হয়।
পরে দুর্বৃত্তরা কবর খুঁড়ে নুরাল পাগলের মরদেহ উত্তোলন করে টেনে হিঁচড়ে পৈশাচিক কায়দায় পূর্ব দিক দিয়ে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পদ্মার মোড়ে নিয়ে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে নৃত্য উল্লাস করতে থাকে।
মামলায় বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়, নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে নুরুল হকের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে রিট পিটিশন করা হয়েছিল। এর প্রেক্ষিতে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আদেশ দেন আদালত। তাই নিরাপত্তা ঝুঁকি প্রশমিত হলে আড়াই মাস পর মামলা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৫ই সেপ্টেম্বর জুম্মার নামাজের পর গোয়ালন্দ বাজার শহীদ মহিউদ্দিন আনসার ক্লাবে উপজেলা ইমান আকিদা রক্ষা কমিটি ও তৌহিদী জনতার ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে একদল মানুষ বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দফায় দফায় নুরাল পাগলার দরবারে হামলা চালায়।
হামলাকারীরা শরিয়ত পরিপন্থীভাবে দাফনের অভিযোগ তুলে নুরাল পাগলের লাশ কবর থেকে তুলে আনে। একপর্যায়ে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোয়ালন্দের পদ্মার মোড় এলাকায় লাশটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে একদল লোকের এই হামলায় ১০/১২ জন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি আহত হয়। হামলায় আহত হয়ে দরবারের খাদেম রাসেল মোল্লা মারা যায়।
এ ঘটনায় রাসেল মোল্লার পিতা আজাদ মোল্লা ৮ই সেপ্টেম্বর রাতে গোয়ালন্দ ঘাট থানায় মামলা করেন। এতে রাসেল হত্যাসহ নুরাল পাগলার দরবারে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, কবর থেকে তার লাশ উত্তোলন করে ঢাকা-খুলনা জাতীয় মহাসড়কে নিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। মামলাটিতে সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার মানুষকে অজ্ঞাত পরিচয় আসামি করা হয়। ওই মামলায় ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ছাড়া পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় ৬ই সেপ্টেম্বর রাতে থানার উপ পরিদর্শক সেলিম মোল্লা তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন। ওই মামলায় পুলিশ মোট ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর