আইসিইউর কাচের ওপাশে শুয়ে থাকা মানুষটিকে দেখলে মনে হয়, তিনি এখনো বেঁচে আছেন। শরীর উষ্ণ, বুক ওঠানামা করছে, মনিটরে ভেসে উঠছে হার্টবিট। কিন্তু চিকিৎসকেরা বলছেন—তিনি ‘ব্রেন ডেথ’। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এমন এক বাস্তবতা, যা পরিবার-স্বজনদের জন্য সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর ও মানসিকভাবে আঘাতের।
ব্রেন ডেথ কী
ব্রেন ডেথ এমন একটি অবস্থা, যেখানে মানুষের মস্তিষ্ক ও ব্রেনস্টেম সম্পূর্ণ ও স্থায়ীভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। যন্ত্রের সহায়তায় তখনও শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন কিছু সময় চালু রাখা সম্ভব হলেও মস্তিষ্ক আর কোনো নির্দেশ পাঠাতে পারে না। ফলে বাইরে থেকে ‘জীবিত’ মনে হলেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ব্যক্তি আর বেঁচে নেই।
চিকিৎসকেরা জানান, মস্তিষ্কের কোষ একবার স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেগুলো আর নতুন করে গড়ে ওঠে না। তাই বড় ধরনের ক্ষতি হলে মস্তিষ্ক আর ঘুরে দাঁড়াতে পারে না।
কীভাবে ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা হয়
ব্রেন ডেথ ঘোষণা একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও কঠোর প্রক্রিয়া। সাধারণত নিউরোলজিস্টরা নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুসরণ করে একাধিক ধাপে পরীক্ষা করেন এবং সব তথ্য লিখিতভাবে নথিভুক্ত করেন। একবার ব্রেন ডেথ ঘোষণা হলে আইন অনুযায়ী সেই তারিখই ব্যক্তির মৃত্যুর তারিখ হিসেবে গণ্য হয়—হৃদযন্ত্র পরে বন্ধ হলেও।
ঘোষণার আগে চিকিৎসকেরা মূলত তিনটি বিষয় নিশ্চিত করেন—
১. কোনো প্রতিক্রিয়া নেই
আলো, শব্দ বা স্পর্শে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
২. সব রিফ্লেক্স অনুপস্থিত
চোখে আলো ফেললে পিউপিল নড়ে না, গলার গ্যাগ রিফ্লেক্সসহ সব রিফ্লেক্স বন্ধ থাকে।
৩. নিজে থেকে শ্বাস নিতে অক্ষম
ভেন্টিলেটর ছাড়া শ্বাস নেওয়ার কোনো চেষ্টা দেখা যায় না।
যেসব পরীক্ষা করা হয়
ভুলভাবে ব্রেন ডেথ নির্ণয় এড়াতে প্রথমেই নিশ্চিত করা হয়—ওষুধের প্রভাব, অতিরিক্ত ঠান্ডা (হাইপোথার্মিয়া) বা রক্তচাপের সমস্যার কারণে এমন অবস্থা হয়নি। এরপর করা হয়—
* শারীরিক পরীক্ষা (চোখে তুলা ছোঁয়ানো, আলো ফেলা, গলার রিফ্লেক্স পরীক্ষা)
* কোল্ড ক্যালোরিক টেস্ট (কানে ঠান্ডা পানি ঢুকিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা)
* অ্যাপনিয়া টেস্ট (ভেন্টিলেটর সরিয়ে নিজে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা আছে কি না)
* প্রয়োজনে ইইজি বা ব্রেন ব্লাড ফ্লো স্টাডি
কোমা ও ব্রেন ডেথ এক নয়
অনেকেই কোমা আর ব্রেন ডেথকে এক মনে করেন, কিন্তু দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। কোমায় থাকা ব্যক্তি বেঁচে থাকতে পারেন, মস্তিষ্কে কিছু কার্যক্রম থাকে এবং অনেক সময় তারা জ্ঞানেও ফেরেন। কিন্তু ব্রেন ডেথ মানেই মস্তিষ্কের সব কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ—ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই।
কঠিন বাস্তবতা
ব্রেন ডেথ গ্রহণ করা যে কোনো পরিবারের জন্য মানসিকভাবে অত্যন্ত কঠিন। যন্ত্রের সহায়তায় শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন চললেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি মস্তিষ্কের মৃত্যু। বাইরে থেকে জীবনের চিহ্ন দেখা গেলেও বাস্তবতা ভিন্ন—এটাই ব্রেন ডেথের সবচেয়ে কঠিন দিক।
সূত্র: ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক, ভেরি ওয়েল হেলথ।
সাজু/নিএ
সর্বশেষ খবর