চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পরও কারা হেফাজতে মৃত্যুর চিত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসেনি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ মাসে দেশের বিভিন্ন কারাগারে অন্তত ১১২ জন বন্দি কারা হেফাজতে মারা গেছেন। নিহতদের পরিবারগুলোর অভিযোগ—চিকিৎসায় অবহেলা ও অমানবিক আচরণের কারণেই তাদের স্বজনদের মৃত্যু হয়েছে। তবে কারা কর্তৃপক্ষ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আসকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসেই কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ৯৫ জন। অথচ ২০২৪ সালের পুরো ১২ মাসে এই সংখ্যা ছিল ৬৫ জন। গত পাঁচ বছরে মোট কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪১২ জনে।
সম্প্রতি হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদের মৃত্যু নতুন করে আলোচনার জন্ম দেয়। সোনালি ব্যাংকের সাড়ে ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত তানভীর আহমেদ গত ২৯ নভেম্বর রাতে কারা হেফাজতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছিলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সেদিন বিকেলে ঢামেকে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।
একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে ঢাকা উত্তরের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা লীগের সভাপতি মনোয়ারা মজলিশের মৃত্যুকে ঘিরেও। গত ২৬ নভেম্বর কাশিমপুর মহিলা কারাগার থেকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।
কারা হেফাজতে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া বন্দিদের বড় একটি অংশই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত সেপ্টেম্বরে সাবেক এক শিল্পমন্ত্রীর মৃত্যুর আগে হাতকড়া পরানো অবস্থায় হাসপাতালের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অসুস্থ বন্দিদের মানবাধিকার নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন ওঠে।
তবে ঢামেক কর্তৃপক্ষ বলছে, চিকিৎসায় অবহেলার সুযোগ নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন,‘অনেকে ডিভিশনপ্রাপ্ত না হয়েও ডিভিশনের সুবিধা দাবি করেন। সেটা না পেলে অভিযোগ তোলেন। চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা কোনো বৈষম্য করি না।’
কারা কর্তৃপক্ষও অবহেলার অভিযোগ নাকচ করেছে। তবে স্বীকার করেছে জনবল ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কথা। কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন,‘কারাগারে ৪১ জন আবাসিক চিকিৎসকের মধ্যে মাত্র দুজন দায়িত্বে আছেন। পর্যাপ্ত আইসিইউ সুবিধা নেই। ইমারজেন্সি হলে সরাসরি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যায় না। তখন নিকটস্থ হাসপাতালে পাঠাতে হয়। এতে কিছু ক্ষেত্রে সময় বেশি লাগে। তবে কোনো গাফিলতি পাওয়া গেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনার সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি সাংঘর্ষিক। মানবাধিকার সংগঠন নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন বলেন, ‘অভ্যুত্থানের আগেও কারা হেফাজতে মৃত্যু উদ্বেগজনক ছিল, এখনো তাই। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল মানুষ। কিন্তু নতুন সরকার এসেও পরিবর্তনের স্বাদ মিলছে না।’
মানবাধিকার সংগঠনগুলো কারা হেফাজতে প্রতিটি মৃত্যুর স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের পাশাপাশি বন্দিদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে কারাগারগুলোতে নিয়মিত বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার পরিদর্শনের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছে।
সাজু/নিএ
সর্বশেষ খবর