শহীদ শরিফ ওসমান হাদির বক্তব্য এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল। তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি সতর্কবার্তা নতুন করে নাড়া দিচ্ছে সাধারণ মানুষকে। জীবদ্দশায় যেসব কথা তিনি বলেছিলেন, দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর সেগুলো যেন আরও গভীর অর্থ নিয়ে সামনে এসেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি ভারতীয় আধিপত্যবাদ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং একটি ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি, দুর্নীতি ও সুবিধাবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ছিলেন তার অবস্থান স্পষ্ট ও আপসহীন।
মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই দেওয়া তার একটি বক্তব্য এখন সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত। সেখানে তিনি বলেছিলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত বুকে বা মাথায় গুলি না লাগবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব না। তবে কেউ আমাদের গুলি করে মেরে ফেললে তাদের ধরে যেন বিচার করা হয়। সেটি করতে না পারলে নতুন কেউ জন্মাবে না।”
দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর এই উক্তি জনমনে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া তার আরেকটি উক্তি ছিল— “আল্লাহ যদি আমাকে নিয়ে যায়, আমার বাচ্চাটার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন।”
এই কথাগুলো এখন বহু মানুষ আবেগভরে শেয়ার করছেন।
শরিফ ওসমান হাদি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে জুমার নামাজের পর নির্বাচনী গণসংযোগে অংশ নিতে অটোরিকশাযোগে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় যাওয়ার পথে দুর্বৃত্ত ফয়সাল করিম মাসুদের গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হন। পরে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সেখানে টানা সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৯টায় সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বেঁচে থাকাকালে বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে বারবার আলোচনায় এসেছিলেন হাদি। তিনি বলেছিলেন, “জীবন যাবে, তবু দেশপ্রেমের প্রশ্নে আপস করব না। পুরো দুনিয়া লিখে দিলেও দেশের সঙ্গে, জমিনের সঙ্গে গাদ্দারি করব না।”
রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে তিনি সাধারণ মানুষকে প্রশ্ন করতে আহ্বান জানিয়ে বলেন, “যে আসবে তাকে জিজ্ঞেস করি—আপনি কী করেন? যদি বলেন রাজনীতি করি। রাজনীতি তো বেতন দেয় না, তবে চলেন কিভাবে? এ প্রশ্ন সবাই শুরু করলে বাধ্য হয়ে এমপি-মন্ত্রীদের ছোট একটি দোকান হলেও দিতে হবে।”
রাজনীতির ক্ষমতার মোহ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “পাঁচ বছরের ক্ষমতার মোহে বিএনপি, জামায়াত বা যেকোনো দল বাংলাদেশকে বেচে দেওয়ার চিন্তা করে। আপনারা কোন দেশে যাবেন? ভারতে যেতে পারবেন না, পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত নেই। বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোনো গতি থাকবে না।”
সাধারণ মানুষকে ভোটের বিষয়ে সতর্ক করে হাদি বলেছিলেন, “আপনারা প্রতীক দেখে নয়, প্রার্থী দেখে ভোট দেবেন। একজন ভালো মানুষকে একবার ভোট দিলে আপনি ও আপনার পরিবার পাঁচ বছর ভালো থাকবে।”
নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও বাস্তববাদী অবস্থান ছিল তার। তিনি বলেন, “নির্বাচন করলে জিতব—এটাই প্রথম কথা নয়। রাজনীতিতে তরুণদের সামনে আনতে চাই। আগামী ৫০ বছরে জিততে বা নাও জিততে পারি। কিন্তু আমরা নতুন একটি ধারা তৈরি করতে চাই। রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তনের জন্য এসেছি।”
জুলাই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়েও গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন হাদি। তিনি বলেন, “এনসিপি তিনটি অপরাধ করেছে। প্রথমত, তারা জুলাই আন্দোলনকে কুক্ষিগত করেছে। দ্বিতীয়ত, অনেকে দুর্নীতি করেছে। যে ছেলেটির সারা গায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল, তারা কীভাবে কয়েক মাসে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়? রাজনীতি পাঁচ বছরের নয়, পঞ্চাশ বছরের।” তিনি সতর্ক করে বলেন, দুর্নীতিবাজরা একদিন বিদেশে পালিয়ে গেলেও প্রকৃত জুলাই যোদ্ধারা এই দেশের বোঝা বইতে বাধ্য হবে।
বক্তব্যে একাধিকবার নিজের মৃত্যুর কথাও স্মরণ করেন হাদি। তিনি বলেছিলেন, “রাজনীতিবিদের মৃত্যু ঘরে হলে সেটা ভালো মৃত্যু না। যে লড়াই করে, তার মৃত্যু হবে রাজপথে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে বুক পেতে শহীদ হতে চাই।”
তিনি আরও বলেন, “আপনাকে যদি হত্যা করা হয়, আর সেই শহীদের রক্তের বিনিময়ে যদি বাংলাদেশ গড়ে ওঠে—আগামী এক হাজার বছর মানুষ আপনার জন্য দোয়া করবে।”
দেশ গড়ার প্রত্যয়ে তিনি বলেছিলেন, “আমরা হয়তো শহীদ হব। কিন্তু যতক্ষণ বেঁচে থাকি, ততক্ষণ ইনসাফের বাংলাদেশের জন্য লড়াই করব। নিজের জীবনকে জাহান্নাম বানিয়ে হলেও নতুন একটি জান্নাত আনবো।”
ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতিও ইনসাফের আহ্বান জানিয়ে হাদি বলেন, “আমি হাসনাতের রাজনীতি করি না। কিন্তু যারা জুলাইয়ের যোদ্ধা, তারা সবাই আমার ভাই। এমনকি আওয়ামী লীগের যারা গণহত্যা, গুম-খুন করেনি, তাদের সঙ্গেও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতে হবে।”
নিজের তিন মাসের শিশুসন্তানকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেছিলেন, “আমার তিন মাসের একটা বাচ্চা আছে। তাকে ৩০ মিনিট কোলে নিতে পারি নাই। মাঝে মাঝে খুব বলতে ইচ্ছে করত—আল্লাহ যদি আমাকে নিয়ে যায়, বাচ্চাটার দিকে খেয়াল রাখবেন।”
আজ তার মৃত্যুর পর সেই কথাগুলোই যেন বাস্তব হয়ে ফিরে আসছে মানুষের হৃদয়ে। বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শরিফ ওসমান হাদি শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা নন, বরং এক গভীর রাজনৈতিক দর্শন ও সংগ্রামী চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর